ইতিহাসের এক মহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে প্রিয় স্বদেশ। আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর পূর্বে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের।সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল।
৫২-র ভাষা আন্দোলন,৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ,৬৬-র ছয়দফা,৬৯-র গণঅভ্যুত্থান,৭০সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়,৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দান। প্রতিটি কঠিন ধাপ অতিক্রম করেই এসেছিল সুমহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত বাঙালির ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে,অসহায় মা-বোনদের পাশবিক নির্যাতন করেছে, মেধাশূন্য করতে নির্বিচারে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে, আবার সেই ঘাতক দলেরই তিরানব্বই হাজার সশস্ত্র সেনা অসহায় কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি।
ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। তখনই পৃথিবীর ভূখণ্ডে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
সদ্য স্বাধীন দেশটা ছিল একটি ধ্বংসস্তুপ। সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত করেছিল পাকিস্তানী শাসকরা। রাজকোষ ছিল শূন্য।সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই ছিল সন্দিহান। ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার,যা গত ২০ বছরে বাড়েনি। আরও এক ধাপ এগিয়ে মার্কিন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তো ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় সেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ‘এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছে। তলাবিহীন ঝুঁড়ি আজ ৪১ তম অর্থনীতির দেশ।দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে আর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানী করতে হয়না।মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ডলারের কাছাকাছি।
স্বাধীন বাংলাদেশের ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম জাতীয় বাজেট বেড়ে আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।মোট দেশজ উৎপাদন,বিনিয়োগ,রাজস্ব আহোরণ, রপ্তানী বাণিজ্য, রেমিটেন্স, রিজার্ভ সব ক্ষেত্রেই ঈর্ষনীয় সাফল্য এসেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল মাইনাস ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ থেকে আজ যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশের উপরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব মার্কেটে দাপট দেখাচ্ছে গার্মেন্ট শিল্প,চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। লাল সবুজের পতাকা নিয়ে মহাকাশে ৫৭তম গর্বিত সদস্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ থেকেও এগিয়ে রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম চালু হল ই-পাসপোর্ট। সামাজিক ও অর্থনীতির সূচকে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।গড় আয়ু,নারীর ক্ষমতায়ন,দারিদ্র্য বিমোচন এবং মাথাপিছু আয়ে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাকিস্তানই নয় ভারতকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
রপ্তানীমূখী শিল্পাঞ্চল,১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল,ঔষধ শিল্পসহ রপ্তানী আয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত নানামূখী প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগে বাংলাদেশের অর্থনীতি দিনদিন বেড়েই চলেছে। নিজস্ব অর্থায়নে গর্বের পদ্মা সেতু,মেট্রোরেল, কর্ণফুলি ট্যানেল,পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ মেগা প্রকল্প গুলো বাস্তবায়নে দেশের অর্থনৈতিক গতিধারাকেই বদলে দেবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পদার্পন করেছে। সরকার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করে ভিশন-২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদ দমনে বিশ্বের রোল মডেল বাংলাদেশ। ১১লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। এতসব অর্জনের মধ্যে এখনও কিছুটা চ্যালেঞ্জও রয়েছে।একাত্তরের মূল ঘাতকদের বিচার ও রায় কার্যকর হলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনও দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ,অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করতে বারবার আঘাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই বিজয় মাসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।এখন সময় এসেছে এদেরকে সমূলে উৎখাত করবার। বাংলাদেশ জন্মের সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ।যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে ।বিশাল জনগোষ্টীর খাদ্যের যোগান দেয়াই ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে অদম্য বাঙ্গালী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।ঠিক তখনই,বিজয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা।তারপর থেকে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন,দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র,রাজনৈতিক সংহিসতা বারবার বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর তাঁর গতিশীল ও দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অনেক বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে দূর্বার দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলছে।বাংলাদেশ এখন একটি অমিত সম্ভবনার নাম।বিশ্বের কাছে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত।স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ।
লেখক : তাপস হালদার
সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।