ব্যক্তিগত এক কাজে গিয়েছিলাম বাংলাবাজার। পরিকল্পনামত সেই কাজ শেষ হওয়ার কথা বিকেল তিনটে নাগাদ। তবে প্রকাশনা সংস্থা কাজ অনেকখানি গুছিয়ে রাখায় আমার হাতে একতোড়া কাগজের খাম ধরিয়ে বললেন, চোখ বুলোলেই হয়ে যাবে!বেলা সাড়ে ১২টায় হাতে অনেকখানি সময় নিয়ে ভাবলাম যাই, ঘুরে আসি সামনের লাল কুঠিতে।

এই নর্থব্রুক হল বা স্থানীয় লোকেদের ভাষায় লালকুঠি, ঢাকার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের স্মারক। ছবি : আল মারুফ রাসেল
ক্যাফে কর্নারে কড়া লিকারের এক কাপ চা আর কুসুম কনফেকশনারির বাটারবান পেটে পুরে ইতিহাসের লাল কুঠিতে ঢুকলাম।
জায়গাটা ফরাশগঞ্জে, যেখানটায় বসে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে মসলা বাণিজ্য নিয়ে রীতিমত লড়াই করেছে ইংরেজ, ডাচ, আর সবার আগে এই এলাকার দখল নেয়া ফ্রেঞ্চ বণিকেরা। পর্তুগিজেরা সবার আগে এলেও বুড়িগঙ্গার এই এলাকার দখল ছিল ফ্রেঞ্চদের, সেই ফ্রেঞ্চগঞ্জ থেকে আজকের ফরাশগঞ্জ।

১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে নর্থব্রুক হল। এটি পরিচিতি পায় ঢাকার টাউন হল হিসেবে। ছবি : আল মারুফ রাসেল
গত মার্চ মাসের পর লাল কুঠিতে আসা হয়নি। তাই শুরুতেই ধাক্কা খেলাম একটু। করোনার কারণেই হোক আর ভর দুপুরের কারণেই হোক, ভেতরে লোকের আনাগোনা কম। ওয়ার্ড কমিশনারের অফিস, ডায়াবেটিক সমিতি, কমিউনিটি সেন্টার, আর অন্যপাশে ফরাশগঞ্জ ক্লাব মিলে সব সময়েই একটু হৈ-চৈ আমাদের গা সওয়া ছিল। সেটা নেই। আরও কিছু একটা নেই, ভাবতে ভাবতেই বোঝা গেল সামনের বড় গাছের ডালপালা ছেটে ফেলা হয়েছে, প্রাঙ্গণ খানিকটা পরিষ্কারও করা হয়েছে। আর হা করে খোলা লাল কুঠির কলাপসিবল গেট।
সাধারণত বন্ধ থাকে সবসময়ে,অবশ্য এই ইমারতের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আরিফুজ্জামান সাহেবকে বললেই নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সোহরাব হোসেনকে দিয়ে খুলিয়ে দেন, ঘুরে দেখতে দেন এর ভেতরের বেহাল দশা। তবে দরজা এমন খোলা থাকলে এমন ব্রিটিশ ঢাকার স্মৃতিবাহী দালানের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মত বোকা অন্তত আমি নই।

১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এখানে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। ছবি : আল মারুফ রাসেল
ভেতরে গিয়ে দেখি গদি ছেঁড়া সিট,ভাঙা কাঠের মঞ্চ, কাঠের সিঁড়ির অবস্থাও বেহাল, সেটা বেয়ে ড্রেস সার্কেলে গিয়ে হাটাচলা করে পেছনের পলেস্তরা খসা ড্রেসিং রুম ঘুরে বেরিয়ে গেলাম উল্টো দিকের দরজা দিয়ে। বিস্ময় সেখানেও ছিল! পেছনটা পুরো ফাঁকা। বাকল্যান্ড বাঁধ পেরিয়ে দৃষ্টি লালকুঠি ঘাটেও যাচ্ছে। পেছনে ময়লার গাড়ি, কোনও এক বাবুর্চির অস্থায়ী থেকে স্থায়ী হয়ে যাওয়া রান্নাবান্নার তেরপল উধাও। ভেঙে ফেলা হয়েছে রাস্তা আর লালকুঠির বাউন্ডারি দেয়ালও। পুরোনো ঢাকায় পুরোনো ঘর,বাড়ি ভেঙে ফেলার খবরে সব সময় দুঃখই পেতে হয়। এই প্রথম কোনো কিছু ভাঙায় দুঃখের বদলে অদ্ভুত প্রসন্নতায় ভরে গেল মন। মানে স্রেফ নির্বাচনী বা রাজনৈতিক মাঠ গরম করার জন্যই ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস পুরোন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘর,বাড়ি সংরক্ষণের কথা বলেননি। কাজও শুরু করে দিয়েছেন। পত্রিকায় পড়া খবরগুলো মিথ্যে নয়!
বাকল্যান্ড বাঁধ মানে যে সড়কটা বুড়িগঙ্গা নদীর থেকে ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল আর তার পাড়ের এই নর্থব্রুক হল বা স্থানীয় লোকেদের ভাষায় লালকুঠি, দু’টোই ঢাকার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের স্মারক। তবে অযত্ন আর অবহেলায় দু’টোরই দশা বেহাল।
১৮৬৪ সালে তৈরি হয় বাকল্যাণ্ড বাঁধ, যেটি তৈরি করিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন কমিশনার চার্লস থমাস। অবশ্য তিনি তার পাঁচ বছরের ঢাকা থাকাকালীন জীবনে তা শেষ করতে পারেননি, এটি শেষ করেন তার পরবর্তী কমিশনার সিম্পসন। আর তার পাড়েই ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে নর্থব্রুক হল। এটি পরিচিতি পায় ঢাকার টাউন হল হিসেবে। তবে প্রচলিত মতবাদ অনুসারে, ১৮৭৪ সালে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে আসা উপলক্ষেই তৈরি হয় এই মিলনকেন্দ্র। ১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এখানে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে মোটামুটিভাবে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মূলত নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ণের জন্য এই মিলনায়তনের একটি সুনাম তৈরি হয়েছিল।

স্রেফ নির্বাচনী বা রাজনৈতিক মাঠ গরম করার জন্যই ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস পুরোন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘর,বাড়ি সংরক্ষণের কথা বলেননি। কাজও শুরু করে দিয়েছেন। ছবি : আল মারুফ রাসেল
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লালকুঠি এসে এর কার্যক্রম বন্ধ পেয়েছি। জেনেছি, এর এক বছর বাদে ২০১৫ সালে লালকুঠি সংস্কারের আবেদন করা হয়েছিল, কাজ হয়নি। পাঁচ বছর বাদে, সংস্কারের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আশা জাগানিয়া। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আরও ৩৯টি দালান সংরক্ষণের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ভবনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আরিফুজ্জামান প্রিন্সের সঙ্গেও কথা হল।
তিনি জানালেন, যথাসম্ভব আদিরূপ ফিরিয়ে আনার নাকি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সব কিছু যদি ঠিক থাকে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়ত এখানেই বসবে বৈশাখি মেলা। আশাবাদী হলাম খানিক।
জানতে চাইলাম, পাশের যে লাইব্রেরিটি ছিল, তার কি হবে? বইগুলো ঠিক আছে তো? তিনি মৃদু হেসে জানালেন, খানিক অপেক্ষা করলে নিজেই দেখতে পাবেন।
শুক্র,শনিবার ছাড়া প্রতিদিন দু’টো থেকে পাঁচটা লাইব্রেরি ব্যবহারের সময়। পুরনো ভাঙাচোরা দালানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাউকে পেলাম না। পরে শুনি লাইব্রেরি এখন পাশের বড় দালানটার তেতলায়। সেখানে গিয়ে কথা হল আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনিই রক্ষণাবেক্ষণ করেন দু’টো আলমারির। কাঠের আলমারিতে বড় করে লেখা PRESENTED BY KUMAR RAJENDRA NARAIN RAY। ভাওয়াল এস্টেটের রাজা, ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল সন্ন্যাসীর বাবার দেয়া বই সেগুলো। তবে কিংবদন্তির গল্পের মতো শুনে আসা, হাজার হাজার বই, সেগুলো কই? আলমগীর ভাই জানালেন, অনেক বই এখনও পড়ে আছে পুরনো সেই ঘরে।

সেই রত্নসম লাইব্রেরি। ছবি : আল মারুফ রাসেল
আলমারিতে ঘুণ ধরেছে, ইঁদুর আর পোকায় কেঁটেছে বই। যাওয়া যায় না সে ঘরটায় ? – জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, আরেকদিন আসেন, দেখি, কি করা যায়! আপাতত হাতে তুলে নিলাম পিপড়াবিদ্যার এক বই, The Fauna of British India, Hymenoptera, VolII-এর আসল একখানা কপি। মলাট ঠিকঠাক থাকলেও সেলাই খুলে আসার দশা। একবার হাত বুলোলাম NORTH BROOK HALL LIBRARY, DACCA লেখা সিলমোহরটায়, আরেকবার ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের সিলমোহরে, যেখানে তারিখ বসানো আছে ১০৫ বছর আগের,জুন মাসের। হয়তো এই বইখানা হাতে কোনো দু:সাহসী ইংরেজ তরুণ পরিকল্পনা করেছিলেন, সুন্দরবন বা বান্দরবান অভিযানের। কে তার হিসেব রেখেছে!