fbpx

একটি পতাকা ও একজন শিবনারায়ণ দাশের গল্প

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রঙ দেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক। বৃত্তের লাল রঙ উদীয়মান সূর্য ও মুক্তির লড়াইয়ে শহীদদের রক্তের প্রতীক। এই পতাকা তৈরির পেছনের ইতিহাসও কম নয়।

সত্তরের দশকের প্রথম দিকে তৎকালীন নেতৃত্বস্থানে থাকা ছাত্রনেতাদের যে ‘নিউক্লিয়াস’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মরিয়া ছিলেন, তাদের সিদ্ধান্তেই পতাকা তৈরির মতো একটি মাইলফলক সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। সে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন একজন শিবনারায়ণ দাশ।

তারিখ ৭ জুন ১৯৭০। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের একটি কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সেই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। পল্টন ময়দানে ছাত্রদের এই কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন জানাতে গঠিত জয় বাংলা বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় একটি পতাকা তৈরির। যে পতাকায় ফুটে উঠবে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন।

১৯৭০ সালের ৬ জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ (বর্তমান ১১৭-১১৮) নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ. স. ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকা তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ।

‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ বইয়ের ১২৮ পৃষ্ঠায় মনিরুল ইসলাম লেখেন, ‘…এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে ৬ জুনের রাতের দ্বিতীয় প্রহরের প্রায় শেষ প্রান্ত উপস্থিত। বলাকা ভবনে ছাত্রলীগ অফিস হওয়ার কারণে নিউ মার্কেটের পাশের কাঁচা বাজার সংলগ্ন এক রঙয়ের দোকান থেকে, দোকানিকে জাগিয়ে, সোনালী রঙ ও তুলি জোগাড় করা হলো। মানচিত্রের নকশা অঙ্কন এবং রঙ করার জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন দেখা দেয়। সে সমস্যাও সহজেই সমাধান হয়ে গেল। সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার ফেস্টুন আঁকার জন্য কুমিল্লা ছাত্রলীগের নেতা শিবনারায়ণ দাশ তখন সেখানে ছিলেন। শুধু ছাত্রনেতা নন, তিনি ছিলেন একজন ভালো শিল্পীও। ফলে তাকে নিয়ে আসা হয় সবুজ জমিনের মধ্যখানে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙ দিয়ে পূর্ব বাঙলার মানচিত্র আঁকার জন্য। ১১৬ নম্বর কক্ষের মেঝেতে বিছিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে পূর্ব বাঙলার সোনালি মানচিত্র আঁকা হল।

সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।

কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউমার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালিন কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুন হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন।’

‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বইতে কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছেন, ‌’…সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালী মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এই সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাশ (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন, মানচিত্রের ওপর শুধু রঙ করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নং কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র।

সোনালী রঙ কিনে আনা হয়। শিবনারায়ণ দাশ ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হলো।

হাসানুল হক ইনু শিবনারায়ন দাশকে নিয়ে যান তার শেরে বাংলা হলে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সে হলের ৪০১ নং কক্ষে শুরু হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা ডিজাইন করার কাজ। রাত ১১টা থেকে ২টা পযন্ত সময় নিয়ে শিবনারায়ণ দাশ সম্পন্ন করলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা ডিজাইনের কাজ।’

একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তৎকালীন ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রব বলেন, ‘সবাই আলোচনা করে পতাকার কাঠামো তৈরি করেন। মানচিত্র অংকন করেন শিবনারায়ণ দাশ। নীলক্ষেতের নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স (যার মালিক ছিলেন একজন বিহারী) পতাকা তৈরি করে দেন। …

সে রাতেই পতাকা সেলাইয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো নিউমার্কেট এলাকায়। বলাকা বিল্ডিংয়ের ৩ তলায় ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সে যোগাযোগ করা হলো। টেইলার্সের ম্যানেজার নাসিরুল্লাহ পতাকা তৈরিতে রাজি হলেন। সেই রাতে শুরু হলো পতাকা সেলাইয়ের কাজ। ভোরের আগেই বেশ কিছু পতাকা তৈরির কাজ শেষ করলেন টেইলর মাস্টার আবদুল খালেক মোহাম্মদী।

৭ জুন সকাল ১০টায় পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ। স্বপ্নের পতাকাটি নিয়ে কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন আ. স. ম. আবদুর রব। আর ছাত্রলীগের পতাকা নিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। আ. স. ম. আবদুর রব হাতে গুটানো স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলেন। তারপর উপস্থিত ছাত্র জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ালেন। কুচকাওয়াজ শেষে নিরাপত্তাজনিত কারণে হাসানুল হক ইনু তার কক্ষে পতাকাটি নিয়ে যান। সহপাঠি শরীফ নুরুল আম্বিয়া শেরে বাংলা হলের ৪০৪ নং কক্ষে খবিরুজ্জামানকে বললেন, পতাকাটি লুকিয়ে রাখতে। দীর্ঘ ছয় মাস পতাকাটি সেখানেই থাকে। পরে ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন সেই পতাকা তার মালিবাগের বাসায় নিয়ে যান।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে স্থগিত ঘোষণার পর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহাসিক ছাত্রসমাবেশ। সেখানে বক্তৃতা রাখেন ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। সে সময় শেখ জাহিদ হোসেন সে পতাকা একটি বাঁশের মাথায় বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মিছিল নিয়ে মঞ্চস্থলে আসেন।’

এরপরের ইতিহাস অনেকেরই জানা। উপস্থিত ছাত্র জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, এই যে আমাদের স্বাধীন বাংলার পতাকা। তখন সবার দৃষ্টি পতাকার দিকে। তখন বজ্রকণ্ঠে স্লোগান ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ রাতের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে অনেকেই তৈরি করলেন সেই পতাকা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্র নেতা আ.স.ম. আব্দুর রব।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে এই পতাকা উত্তোলন করেন। এছাড়া পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ওড়ে শিবনারায়ণ দাশের নকশা করা জয়বাংলা বাহিনীর সেই পতাকা। সে থেকে পতাকাটি পরিণত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা এটিই।

যে পতাকা দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ জয় করা হলো, সে পতাকা পরিবর্তন হয়ে যায় মাত্র ২৭ দিনের ব্যবধানে। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের পতাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হয় মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের মানচিত্রটি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন পটুয়া নামে খ্যাত শিল্পী কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা অসুবিধাজনক ছিল। পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলার এটি অন্যতম কারণ। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সরকারিভাবে গৃহীত হয়।

স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাশ এখনও জীবিত আছেন। নিভৃত জীবনযাপন তার। থাকেন ঢাকার মণিপুড়িপাড়ায়। গণমাধ্যম, প্রচার – এর কোনো কিছুতেই তিনি নেই।

প্রথম জীবনে কুমিল্লায় ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা শিবনারায়ণ দাশের। এরপর যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতি। ছিলেন মুক্তি সংগ্রামের প্রথম কাতারে।

এখন এই মানুষটির নেই কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী এবং এক সন্তান অর্ণব আদিত্য দাশকে নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন ইতিহাস চাপা পড়া জীবন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও এই বীর সংগ্রামীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকার নকশাকার পাননি স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদকের মতো কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ‘অপরাধে’ পাক হানাদাররা তাকে খুঁজে না পেয়ে তাঁর বাবা সতীশ চন্দ্র দাশকে গাড়ির সাথে বেঁধে নিয়ে গুলি করে মেরেছিল। আজ পর্যন্ত বাবার লাশটিও খুঁজে পাননি হতভাগ্য শিবনারায়ণ দাশ।

কিছু বিশেষ দিবসে এখন অনেক কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তাতে থাকে না শিবনারায়ণ দাশের নাম। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই।

অনেক চেষ্টার পর গত ১১ ডিসেম্বর ২০২০ শিবনারায়ণ দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়। কোনো সাক্ষাৎকার দিতে তিনি অসম্মত হন।

বিবিএস বাংলা’র প্রতিনিধিকে শিবনারায়ণ দাশ বলেন, ‘আমি চাই জীবন বাজি রাখা দেশটির সার্বিক মঙ্গল। মানুষের মঙ্গল। এর চেয়ে আর কোনো বেশি চাওয়া নেই আমার।’

নিজেকে জ্বালিয়ে নি:শেষ হওয়া স্ফুলিঙ্গ জীবন এমনই। অনেক আলোর উপস্থিতির পর তার অস্তিত্ব থাকেনা। শিবনারায়ণ দাস আমাদের মুক্তির লড়াইয়ে তেমনই এক স্ফুলিঙ্গ।

Advertisement
Share.

Leave A Reply