বাংলায় বাঙালিদের নিয়ে ক্রিকেট খেলার চল শুরু করেছিলেন কিশোরগঞ্জ এলাকার জমিদার বংশের লোকেরা। এভাবে বললে অবশ্য ঠিক খোলা করে বোঝা যায় না। বলতে হবে, রায় পরিবারের ব্যক্তিরা- সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা ও পাঁচ ভাই- সারদারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন মিলে। বলা হয় ১৮৭০ সালে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মশুয়ার এক মাঠের খেলা। সেটাই কাগজে কলমে বাঙালিদের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ। একই সময়ে প্রমীলা ক্রিকেটের যাত্রা হয়েছিলো বাংলার মাটিতে।
ঢাকার মাঠের ক্রিকেট নিয়ে মুনতাসীর মামুন স্যারেরও লেখা পাওয়া যায়। তবে আমাদের এপার বাংলায় ক্রিকেটের ইতিহাস চর্চায় মূল সমস্যা অগ্রজদের রেখে যাওয়া দলিলপত্রের অভাব আর এই সুযোগে ওপার বাংলার ইতিহাস চর্চা জারি থাকা, আর সেখানে ভেতো বাঙালদের অনুপস্থিতি। অনুপস্থিতির পেছনে দুটো কারণ হতে পারে, এখন যারা লিখছেন, তারা এখনকার ভারতের প্রেক্ষাপটে লিখছেন, ফলত স্বাধীন সার্বভৌম একটা দেশ সে ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে, আরেকটি কারণ হল সেই সময় থেকেই ঢাকা আর কলকাতার দলগুলোর শত্রুতা। সে নিয়েও আলাপ রয়েছে মুনতাসীর মামুন স্যারের বইয়ে।
তবে আমি যেটা নিয়ে আলাপ করব সেটা হারিয়ে যাওয়া এক ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে।

১৮৮৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি ক্রিকেট ম্যাচ। ছবি : সংগৃহীত
সৌভাগ্যক্রমে এই ম্যাচের স্কোরকার্ড চলে আসে ঢাকার আর্মেনিয়ান সম্প্রদায় নিয়ে একটু পড়াশোনার সময়ে। আর্মেনিয়ানরা সম্ভবত সপ্তদশ শতকের শেষ দিক থেকেই আসতে থাকে ঢাকায়। ঢাকার তেজগাঁওয়ের গির্জা প্রাঙ্গণে কয়েকটি আর্মেনিয় সমাধি রয়েছে যেগুলো ১৭১৪ থেকে ১৭৯৫ সালের। আর্মেনিয়ানদের একটি বড় অংশের বাস ছিল আর্মানিটোলায়। এর পাশাপাশি মৌলবীবাজার আর নলগোলাতেও থাকতেন অনেকে।

নারিন্দায় আরমেনিয়ান কবরস্থান। ছবি: আল মারুফ রাসেল
অষ্টাদশ শতকে আর উনবিংশ শতকের শুরুতে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ঢাকায় আরমেনিয়ান সম্প্রদায় বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ঢাকা শহরে আর্মেনিয়ান ট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ বলতে রয়ে গেছে কেবল আন্টাঘর ময়দান,মানুক হাউজ (বঙ্গভবন) আর রূপলাল হাউজ, আর্মেনিয়ান চার্চ, তিনটি সমাধিক্ষেত্রে তাদের সমাধি আর পোগোজ স্কুল। রিকশাও এই তালিকায় চলে আসে। আর ইন্ট্যাঞ্জিবল প্রভাব যা রয়েছে তা মূলত খাবারে, এর মধ্যে পোলাও, বাকরখানি আর চায়ের কথাই প্রথমে মাথায় আসে।

পুরনো শহরে আর্মেনিয়ান চার্চ। ছবি : গ্রান্ড পিটারসন
ঢাকার পোগোজদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত জমিদার নিকি পোগোজ। জোয়াকিম গ্রেগরি নিকোলাস পোগোজ, পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, জমিদার, ব্যবসায়ী আর ঢাকার কাউন্সিলরদের একজন। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রাঙ্গণেই নাকি ছিল একখানা ক্রিকেট মাঠ।
সে যাই হোক, ফিরে আসি খেলায়। ১৮৭৩ সালের একটি ক্রিকেট ম্যাচের উল্লেখ পাই একটি ক্রীড়া সাময়িকীর এক পাতায়। পাতার শুরুতে ১৭ জানুয়ারির ঘোড়দৌড়ের উল্লেখ রয়েছে, সেখানে রেসের জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত নাম খুঁজে পাওয়া বাবু মোহিনী মোহন দাসের, ফুলটন সাহেবের আর নবাব আহসান উল্লাহর। তার শেষে উল্লেখ রয়েছে, রেস শেষে সন্ধ্যায় আহসান উল্লাহর বাড়িতে (আহসান মঞ্জিল, উল্লেখ করা প্রয়োজন তার এক বছর আগেই এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়)বল নাচের আয়োজন করা হয়। আগের সন্ধ্যায় সেখানেই গ্র্যাণ্ড পার্টিরও আয়োজন করা হয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে।
এরপরেই মেলে ক্রিকেট ম্যাচের বিবরণ:- ‘শনিবারে (১৮ জানুয়ারি, ১৮৭৩) একটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার স্কোর সংযুক্ত করা হল, আর সেদিন সন্ধ্যাতেই, বাবু মোহন দাস স্টেশনের সবাইকে ইস্টার্ন বেঙ্গল থিয়েটারে (পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি, এখন যেথানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে বা তার আশেপাশে) আমন্ত্রণ করেন, যেখানে বক্স অ্যাণ্ড কক্স ও চাখুদান (চক্ষুদান) প্রহসনে স্থানীয় অভিনেতারা অংশ নেন।
খুব সুন্দর খেলা হয়েছিল। কিউবিট তার কলকাতার পুরনো চেনা ‘ফর্মে’ বল করতে শুরু করেন, কিন্তু স্মিথ দৃঢ়তার সাথে খেলতে থাকেন, সেই সাথে বাজে ফিল্ডিং বিশেষত লং অনে, তাকে তুলে না নেয়ার পরও (কিউবটের) নয় উইকেট খারাপ ছিল না। অন্য বোলাররা, পিটার ও পল পোগোজদের ভেতরে প্রথমজন বেশ ভাল বোলিং করেছিলেন।
অন্যদিকে থর্টন ও ফিলিপস বোলিং শুরু করেন, কিন্তু প্রথমজন লেনথ ঠিক করতে পারছিলেন না। দু’জনকেই ভালো মতো শাস্তি দিতে থাকেন পোগোজেরা ও কিউবিট, তাই লায়াল ও স্মিথকে দিয়ে চেষ্টা করা হয় ও দ্রুত উইকেটের পতন হতে থাকে। ফিলিপস ভালো শুরু করলেও সংক্ষিপ্ত ছিল তার স্পেল। কিউবিট ও পল পোগোজ তাদের স্কোরের জন্য ভালই খেলেছিলেন আর পিটার পোগোজের সংক্ষিপ্ত ইনিংসে দু’টি ছয় ছিল।
খেলা শেষে সেদিনই সফরকারী একাদশ গাড়ি চালিয়ে ১৩ মাইল দূরে টঙ্গীতে গিয়ে বর্শা দিয়ে শূকর শিকার (পিগ স্টিকিং) করে।
এখানেই এসে শেষ হয় বিবরণ। ধারণা করা হয়, ম্যাচটি পুরোই অনানুষ্ঠানিক আর প্রীতি ছিল, কারণ কলকাতা থেকে আসা কিউবিট খেলছেন পোগোজদের দলে। আর অন্যরাও সম্ভবত ঢাকায় থাকা অভারতীয়। তিনজন পোগোজকে এখানে দেখা যাচ্ছে, পিটার পোগোজ, পল পোগোজ আর এন (নিকি?) পোগোজ। পল পোগোজকে দেখা যাচ্ছে উইকেট রক্ষকের ভূমিকায়, পিটার পোগোজ একটা উইকেটও নিয়েছিলেন, আর যদি মুদ্রণপ্রমাদ না হয়ে থাকে তাহলে উইকেটের পিছেও দাঁড়িয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য আর একটা স্ট্যাম্পিংও করেছিলেন, পল পোগোজের পবিবর্তে, যখন তিনি বল হাতে নিয়েছিলেন। আর প্রথম ইনিংসের বাকিটা বলে দিচ্ছে পুরোটাই ছিল কিউবিট-ময়। এক ইনিংসে এর আগে কেউ কি নয় উইকেট বগলদাবা করেছিল? জিম লেকারের ১৯ উইকেটের ম্যাচ ১৯৫৬ সালের ঘটনা, আর এটা ১৮৭৩ সালে ঢাকার মাঠে!
লেখা থেকে মোটামুটি পরিষ্কার কিউবিট কলকাতায়ও ভাল ফর্মেই ক্রিকেট খেলেছিলেন। কিউবিট সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেল তিনি জন্মেছিলেন কলকাতাতেই ১৮৩৫ সালে, বিয়েও করেছিলেন কলকাতায় এক শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে। লখনৌ, আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা উইলিয়াম জর্জ কিউবটের ঝুলিতে রয়েছে। শুধু ঝুলিতে বললে ভুল বলা হয়, ১৮৫৭ এর সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার সবচেয়ে দুর্দান্ত বিদ্রোহী এলাকা লখনৌয়ে ইংরেজ পক্ষের নায়ক ছিলেন তিনি রীতিমত। আর শেষ জীবনে কর্নেল হিসেবে অবসর নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন সারে, ইংল্যাণ্ডে। সেখানেই ১৯০৩ সালে মারা যান। তিনি যখন ঢাকার মাঠে এই ম্যাচ খেলেছিলেন, তিনি তখনও সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
এই খেলার পিটার পোগোজ (পিটার নিকোলাস পোগোজ) ছিলেন সম্ভবত জমিদার নিকি পোগোজের চাচাত ভাই নিকোলাস পিটার পোগোজের ছেলে। নিকোলাস পিটার পোগোজ তার চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটও হয়েছিলেন ১৮৭৬ সালে। যা হোক, ছেলে পিটার পোগোজ ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সফল ছিলেন না আর জীবিকার তাগিদে তিনি বিভিন্ন রকম লোক ঠকানোতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৮৪ সালে আসামী হিসেবে তার বিরুদ্ধে করা মামলা কলকাতা কোর্টে আলোড়ন তুলেছিল। সব আর্মেনিয়ানই যে সফল আর ধনী ছিলেন না, তার প্রমাণ মেলে এখান থেকে। খেলার পিটার পোগোজ বিয়ে করেছিলেন ইউজিন মানুককে।

পিটার পোগোজ। ছবি : সংগৃহীত
পল পোগোজ ছিলেন্ জমিদার নিকি পোগোজের চতুর্থ ছেলে। ১৮৫৩ বা ১৮৫৪ সালে জন্ম, আর মৃত্যু হয়েছিল ১৮৭৬ সালের অক্টোবর মাসে, ২২ বছর বয়সে। পল পোগোজের মৃত্যুর কিছুদিনের পরেই, ডিসেম্বরে মারা যান জমিদার নিকি পোগোজও। দু’জনের সমাধি রয়েছে ঢাকার নারিন্দা খ্রিষ্টান সমাধিক্ষেত্রে, পাশাপাশি। আরেকজনের নাম মেলে স্কোর কার্ডে এন পোগোজ, ভুল না হলে তিনি ছিলেন পল পোগোজের ভাই, নিকি পোগোজের প্রথম সন্তান। কারণ তৃতীয় সন্তান নিকোলাস জোয়াকিম পোগোজ ১৮৭২ সালে সাসেক্সে মারা যায়, দ্বিতীয় সন্তান জন অ্যাভডাল পোগোজের জন্য এন অদ্যাক্ষর মেলে না। রয়ে যান নিকি সাহেবের বড় সন্তান গ্রেগরি জোয়াকিম নিকোলাস পোগোজ। তবে বেঁচে থাকা এই দুই সহোদরেরাও খুব একটা ভাল সময় পার করেননি পরবর্তীতে, মানসিক রোগে আক্রান্ত হন তারা।
ঢাকায় আর্মেনিয়ানদের প্রাধান্য ব্যবসা-বাণিজ্যে তো ছিলোই, সেই সঙ্গে খেলাধুলায়ও যে তারা আগ্রগামী ছিল তার প্রমাণ এই ক্রিকেট ম্যাচ। সাহেবি এই খেলায় তখনকার ঢাকায় থাকা ১২১ জন আর্মেনিয়দের মধ্যে পিটার পোগোজ আর দুই ভাই নিকোলাস পোগোজ আর পল পোগোজের উপস্থিতি প্রমাণ করে ঢাকার অভিজাতদের ভেতর তাদের প্রাধান্যও।
তথ্যসূত্র:
মুনতাসীর মামুন: ঢাকা সমগ্র ১, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৯৫।
মুনতাসীর মামুন: ঢাকা সমগ্র ২, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৯৬।
মিহির বোস: দ্য ম্যাজিক অফ ইণ্ডিয়ান ক্রিকেট,রটলেজ, ১৯৮৬।
ও ১৮৭৪ এর একটি ক্রীড়া সাময়িকী।