মনে নেই ঠিক সন, তারিখ। সম্ভবত সেটা ১৯৮১,৮২ সাল। একান্নবর্তী পরিবারে থাকি আমরা। বয়স তখন ৫/৬ বছর। রাতে দেখলাম মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন খালা।
পরদিন শুনলাম আমার একটা ছোট্ট বোন হয়েছে। তার গায়ের রঙ আমার মতোই কুঁচকুঁচে কালো। তার ডাকনাম রাখা হলো মৌ। আর দীর্ঘ নাম মেহজাবিন রেজা চৌধুরী। মনে মনে ভাবলাম, ভালোই হলো, ছোটবোন পেলাম। ভাই-বোনের জুটি হলাম আমরা।
বেড়ে ওঠার সময়েও কখনোই আমরা আলাদা হইনি। মৌ আমাদের সঙ্গে ফুটবল ক্রিকেট সবই খেলত। পুতুল নিয়ে ও কোনোদিন খেলেনি। ফুটবলে ও খেলত স্ট্রাইকার পজিশনে। তবে ও শুধু আমাকেই ফলো করত। আমাদের বাড়িতেও এরকম পরিবেশ ছিল। ছেলে-মেয়ে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই এখানে।
ভিকারুন্নেসায় ভর্তির পরও মৌ খেলা ছাড়েনি। অ্যাথলেটিক্সে খুব ভালো করছিলো। এখন এই বয়সে আমার মনে হয় আমার বোন তো একজন দেশ সেরা অ্যাথলেট হতে পারত। সে সম্ভাবনাও ওর ছিল। কিন্তু সে সময়ের বাংলাদেশে নারী ক্রীড়াবিদ তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। পাড়ায় ছিল না মেয়েদের জন্য কোনো ক্লাব। খেলাকেও পেশা হিসেবে নেওয়ার পরিস্থিতি ছিল না।
আগেই বলেছি, আমার বোন আমাকে ফলো করতো। ও বিবিএ শেষ করে আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘হাফ স্টপ ডাউন’এ যোগ দিলো। কোথায় কাজ করেনি ও! আর্ট ডিরেকশন, কস্টিউম ডিজাইন, কাস্টিং ডিরেক্টর, অ্যাকাউন্টস…। আমার ছবিতে দেশি, বিদেশি খ্যাতনামা নেপথ্যের ব্যক্তিদের কাছে কাজ শিখেছে সে। ছোট ছোট সব কাজ শিখেই ও নির্বাহী প্রযোজক, এমনকি প্রযোজকের দায়িত্বও পেয়েছে। ‘হাফ স্টপ ডাউন’কে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার সিংহভাগ কৃতিত্বই আমার বোনটির। প্রথমে দেখেছি, অনেক ছেলের মানতে কষ্ট হতো একটি মেয়ের নির্দেশনা। কিন্তু মৌ তার যোগ্যতা দিয়েই তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। কাজের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে কাছে টেনেছে। আমি নিশ্চিত, বাংলা ছবির ধারা পরিবর্তনে নেপথ্যে থাকা এই নারীর অবদান একদিন স্বীকৃতি পাবেই। আমার বোন বলে এমনটা বলছি না। আর নারী হিসেবেই বা কেন? ব্যক্তি মেহজাবিন রেজার কীর্তি তো কম দেখিনা। এজন্য নিজের বোনকে দেখে একটা কথা প্রায়ই মনে হয়। তা হলো, যদি কেউ বলে না দেয় তুমি মেয়ে, তবে তুমি বেড়ে উঠবে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে।
আমার এই প্রিয় বোনটির আজ জন্মদিন। অনেক শুভকামনা ওর প্রতি। আর উইশ হিসেবে বলতে পারি একটা কথাই। তাহলো,
“কখনো ভেবো না তুমি শুধুমাত্র আমার বোন, তুমি সেই সত্ত্বা যে তৈরি করেছে আমাকে”