fbpx

পরশ্রীকাতরতা তৈরি হয় শৈশবেই

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

সম্প্রতি জামাল সাহেব ভাড়া বাসা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছেন, সে উপলক্ষে তার আগের বিল্ডিংয়ের প্রতিবেশীদের দাওয়াত করলেন! দাওয়াত খেয়ে আসার পর দুই প্রতিবেশী ভাবী কানাঘুষা শুরু করলেন। বুঝলেন ভাবী, এতবড় ফ্ল্যাট কিনলেন জামাল ভাই! বেতনের টাকা দিয়ে কি আর সম্ভব! সবই বুঝি আমরা, মুখে বলিনা।

ভাই শুনছেন? অমুক ভাইয়ের বড় ছেলে বিদেশে গিয়ে ছিলোনা? ওতো বিদেশী মেয়ে বিয়ে করেছে। শুনলাম বৌ এর উছিলায় ছেলেতো এখন ঐ দেশের নাগরিক হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। ঐ ছেলেকে কি আর দেশে আসবে মন করেছেন!!

এখানে সমস্যা কোথায়? জামাল সাহেব বেতনের টাকা জমিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন সেটা নাকি তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন এটা প্রতিবেশীদের ভালো না লাগা! কিংবা অমুক ভাইয়ের বড় ছেলে তাড়াতাড়ি একটি উন্নত দেশের নাগরিক হয়ে যাবেন!

আমি তো এটা পারিনি, সে কেন পারবে! আমার কেন নেই, আমারো সব পেতে হবে! এই ধরনের চিন্তাধারার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে পরশ্রীকাতরতা।

বাংলা একাডেমির অভিধানে পরশ্রীকাতর শব্দটির অর্থ এভাবে দেয়া আছে, অন্যের উন্নতি বা সৌভাগ্য দেখে কাতর বা ঈর্ষান্বিত হয় এমন। পরশ্রীকাতর শব্দটির বিশেষণ হলো পরশ্রীকাতরতা।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে-এক হলো আমরা মুসলমান, আরেক হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তে রয়েছে।

ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে কিন্তু বাঙালির মধ্যে রয়েছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয়না। এজন্যই বাঙালি জাতির সকলরকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার সতীদাহপ্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনের পথে বাধা হিসেবে বাঙালির পরশ্রীকাতরতাকে দায়ী করেছিলেন।

তিনি একটা কথা বলে গেছেন, একজন বাঙালি নারীর প্রধান শত্রু আরেক বাঙালি নারী। এর প্রধান কারণ হলো পরশ্রীকাতরতা।

সভ্যতাবোধের অভাব আর মানসিক নীচতা থেকে পরশ্রীকাতরতার উৎপত্তি। স্বাভাবিকভাবে মানুষ হিসেবে অন্যের ভালো দেখে আমাদের খুশি বা আনন্দিত হওয়া উচিত।
আদিম যুগেও মানুষ ছিলো সংঘবদ্ধ, এখনো আমরা সমাজবদ্ধ। সমাজবদ্ধতার কারণে মানুষ যুগে যুগে একে অন্যের সুখে সুখী, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়ে এসেছে। এটাকে বলে সহমর্মিতা, এটা না থাকলে মানুষের মানুষ বলে পরিচয়টা মূল্যহীন।

জীবনের সবচেয়ে বড় মানসিক চাপ হলো পরশ্রীকাতরতা। অহেতুক স্ট্রেস বাড়ায় পরশ্রীকাতরতা।
কেন ওরা গাড়ী কিনলো, আমি কেন পারলামনা কিনতে,বন্ধু কিংবা ভাই-বোনের ছেলেমেয়েরা কেন নামী ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে,আমাকেও সাধ্যের বাইরে গিয়ে আমার ছেলেমেয়েদের ওরকম স্কুলে পড়াতে হবে, এগুলো সবই আসলে নেগেটিভ বা নেতিবাচক মানসিক চাপ।

আর যদি বলি রাজনৈতিক পরশ্রীকাতরতার কথা, উফফ..! এখানে পরশ্রীকাতরতা বা হিংসা বিদ্বেষ যেন অন্যমাত্রা লাভ করে! আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পরশ্রীকাতরতার কারণে আজ জাতীয় ঐক্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। একদল যখন ক্ষমতায় থাকে, অন্য দলগুলো তখন সহ্য করতে পারেনা। ক্ষমতাসীন দলের সকল কাজেই তখন গা জ্বালা করে।

এই রাজনৈতিক হিংসা বিদ্বেষ কিন্তু শুধুমাত্র এক দলের সাথে অন্য দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিজেদের ভেতরেই চলে সীমাহীন পরশ্রীকাতরতা। অমুক মন্ত্রীর গাড়িটা বেশি দামী, অমুক নেতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে! আবার দলে নতুন কেউ এসে উৎসর্গীকৃত মনোভাব নিয়ে যখন কাজ করতে থাকবে, দলের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে চাইবে। তখনই শুরু হবে তার পা ধরে টান। এ তো নতুন, একে কেন এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, নিশ্চয়ই ওপর মহলে তার অন্যরকম যোগাযোগ… আরো কত কী!

পরশ্রীকাতরতা তৈরি হয় শৈশবেই। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য কিংবা অভিভাবকেরাই মূলত দায়ী। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের ভেতরে প্রতিযোগিতার নামে একটা অসুস্থ মানসিকতা তৈরি করেন অভিভাবকগণ। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়!

অন্যের আনন্দে আনন্দিত হতে পারার মধ্যে কিযে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি, তা এদের কাছে চির অধরাই থেকে যায়..! যতদিন তারা বেঁচে থাকেন, সকলের মাঝে থেকেও যেন তারা কোনো দূর পরবাসে।

পরশ্রীকাতরতার মতো একটা বাজে বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত করা উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব। নিজেকে যদি পরশ্রীকাতর বলে মনে হয় তবে উচিত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা।

আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে, সহজ হয়ে সকলের সাথে মন খুলে মেশা উচিত। অন্যের ভালোতে নিজের ভালোলাগার অভ্যেস করা।

আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো,যাদেরকে আমরা বন্ধু বা কাছের মানুষ ভাবি,তাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে অনেক পরশ্রীকাতর মনোভাবের মানুষ। আপনি ভালো আছেন এটাই ঠিক ভালো লাগেনা তাদের।

ব্যস্ত থাকুন,নিজের জীবন নিয়ে ভাবুন, সৎ থাকুন, ভালো কাজ করুন। একদিন আপনাকেও অনেকে ভালোবাসবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী

Advertisement
Share.

Leave A Reply