fbpx

পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া সেই মহীয়সী

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

নেলসন ম্যান্ডেলা তার জীবনের রাজনৈতিক উত্তরণে স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে তার যথাযথ কৃতিত্ব আমৃত্যু দিয়ে গেছেন। একজন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন আমরা পেয়েছিলাম বেগম রোকেয়ার শ্রদ্ধেয় সঙ্গীর উৎসাহে, সহযোগিতায়। যারাই বিশ্বে অমর হয়ে আছেন অধিকাংশের জীবন ঘাটতে গেলেই এরকম স্নেহ, মায়া ও ভালোবাসায় ভরা নিখাদ সহযোগিতা আর উৎসাহের একজন করে সঙ্গী পাওয়া যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার জীবনে রেণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্ত অবদান, সাহস ও উৎসাহ দ্বিধাহীনভাবে স্মরণ করেছেন, লিখে গেছেন আগামীর জন্য।

জেলের কোষ্ঠ ৪ হাজার ৬৮২ দিনের জীবন কেটেছে বঙ্গবন্ধুর। রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসার চাপ কখনো পরিবার থেকে অনুভব তিনি করেননি। অল্প বয়েসে বাবা-মা হারানো রেণুর যে দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা নিয়েছিলেন আজীবন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, মানসিক, পারিবারিক সমস্ত দায়িত্ব বঙ্গমাতা তার কাঁধে নিয়েছেন, পালন করেছেন সুনিপুণ ভাবে৷

স্বামীকে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার চাপ দেয়া তো অনেক দূরের কথা বরং স্বামীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক উপদেষ্টা যদি কাউকে বলা যায় আমার কাছে সেটি একবাক্যে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া সেই মহীয়সী

১৯৬১ সালে কারামুক্তির পরে বঙ্গবন্ধু আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ছোট ছোট সন্তান নিয়ে কখনো সরকারি বাসভবন, কখনো ধানমন্ডি, কখনো নাজিরাবাজার অথবা সেগুনবাগিচা – অনেক কষ্টে ঘর ভাড়া নিয়ে দিন কাটানো বঙ্গমাতার জীবনে একটু স্বস্তি আসে। স্বামীর মামলার জন্য উকিলের ফি দিয়ে সন্তানদের পড়ানোর জন্য আলাদা টিউটর রাখা কষ্টসাধ্য হলে সন্তানদের জানান ” তুমি ঠিকমতো পড়ছো না, তাই তোমার দায়িত্ব আমার।” আবার কখনো ” প্রতিদিন ভাত তরকারি ভালো লাগেনা, আজ আমরা খিঁচুড়ি খাবো, খিঁচুড়ি অনেক মজা। ”

সন্তানদের অভাব বুঝতে না দিয়ে বরং চাপমুক্ত রেখেছেন। সারাক্ষণ দৌড়ের জীবনে একটু খানি ভালো সময় বঙ্গবন্ধুর কোম্পানির চাকরির পরেই তিনি পেয়েছিলেন।

১৯৬৬ এর ছয়দফা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই ছয় দফার সময়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তায় ছিলেন রেণুর সিদ্ধান্তের। সেই রেণুই স্পষ্ট জানিয়েছিলেন ” আমি শেখ মুজিবের স্ত্রী, এই পরিচয় নিয়ে মরলেও খুশি হবো। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বড় সাহেবের বিবি পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমি বছরের পর বছর ছেলে মেয়ে নিয়ে কষ্ট করি নাই। ”

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকের জন্য বঙ্গমাতা সবার আগে এর বিপক্ষে যান। তৎকালীন নেতারা বলেছিলেন – ভাবি, আপনি তো বিধবা হবেন। দৃঢ় রেণু উত্তর দিয়েছিলেন-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪জনই বিবাহিত, আমি তো একা না, মামলা প্রমাণিত হলে ৩৪ জন বিধবা হবে। আমার একার চিন্তা করলে হবে না। মামলা উইথড্র না করলে উনি ( বঙ্গবন্ধু) লাহোরের সম্মেলনে যাবেন না।
এরপরে সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধুকে তিনি জানান – “আজ তুমি যদি প্যারোলে যেতে রাজি হতে তাহলে তোমার বিরুদ্ধে আমি পল্টনে জনসভা করতাম।”
রেণুর এই সিদ্ধান্ত এতো সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলো যে সেদিন প্যারোলে মুক্তি না নেয়ায় দেশবাসীর কাছে মহানায়কে পরিণত হয়ে ঠিক পরের বছরই বঙ্গবন্ধু বাঙালির প্রাণের “বঙ্গবন্ধু” হয়ে ওঠেন।

এক রাজনীতিবিদের সাথে ছেলেবেলার পুতুল খেলার সময়ে যে জীবন জড়িয়েছিলো রেণুর সেই রেণুই ছায়ার মতো থেকেছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। জেলে থাকাকালীন রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সাথে ক্রমাগত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ছাত্রলীগের ছেলেদের লিফলেট ছাপানোর আবদারে নিজের কাছে থাকা একমাত্র সম্বল ৫০টাকা বিনাবাক্যে দিয়েছেন। স্বামীকে ছাড়া দিনের পর দিন জীবন যাপন করে সন্তানদের শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে মননশীল মানুষ তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে বোরখা পরে লিফলেট বিতরণ করেছেন জনমানুষের সমর্থন জোগাড়ে। ছেলেদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করেছেন। ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া ছোট্ট রেণুই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া সেই মহীয়সী।

পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া সেই মহীয়সী

পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে স্বামীকে নির্ভার রেখেছেন। রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন৷ আবার কখনো কখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো দিয়ে তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর মাথার যথার্থ মুকুট তার রেণু। এতো কিছুর পরেও কোনোদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের বউয়ের স্বভাবসুলভ আচরণ করেননি। ইন্ধিরা গান্ধী ঢাকায় আসলে কাতান শাড়ি পরে পানের বাক্স নিয়ে সেই অনুষ্ঠানে আটপৌরে বাঙালিয়ানার ছাপ নিয়ে যেই নারী উপস্থিত ছিলেন তিনিই আমাদের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মেধায়, মননে, ব্যক্তিত্বে বলীয়ান মহীয়সীর
৯১তম জন্মদিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক
অন্তরা শারমিন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement
Share.

Leave A Reply