১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ধরাশয়ী করে বিজয়ের সূর্য ছিনিয়ে আনে বাংলার দামাল ছেলেরা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত হয় স্বাধীনতার লাল সবুজের মানচিত্র। আর সবার আত্মনিবেদন ও গৌরবগাঁথা গণবীরত্বে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত হয় বীর বাঙালি জাতি।
আমাদের এই বিজয়ের ইতিহাস একদিনের নয়। যার বীজ বোনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। র্যাডক্লিফ কমিশন এবং তৎকালীন নেতাদের জন্য দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ভারত এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এর সিংহভাগ বাঙালি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালির ওপর শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়।
সেই অবস্থা থেকে এদেশের মানুষকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে উপনীত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সে রাতে তারা হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জনে মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে উদিত হয় বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।
পেরিয়ে গেছে ৪৯ বছর। সবুজ শ্যামল এই দেশের ডালিতে যুক্ত হয়েছে অনেক কিছু। আবার ঝরেও গেছে বহু মূল্যবান রত্ন। দেশ যখন সবে মাত্র ভূমিষ্ঠ হলো, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাচ্ছিল্য করে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিলেন। সেই তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এখন আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান সুনিশ্চিত করেছি।
আমাদের দেশের সাফল্য দেখে তাই বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে।’
শুধু তাই নয়, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মতে,‘শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ আছে।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন,‘শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারী পুরুষের সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য বিশ্বের বুকে
অনুকণীয়।’ এই বাণী যেনো আমাদের কানে মধুর সংগীতের মতো শোনায়। বাঙালি হিসেবে গর্বে বুক ভরে ওঠে।
বাংলাদেশের এই উন্নয়নের সূচনা ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। একটু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে তিনি যখন পা দিলেন তখন তার অভিব্যক্তি ছিল অনেকটা এমনই- ‘শত্রুমুক্ত হবার পর দেশে কোনো পরিকল্পনা কাঠামো ছিল না, অথবা অর্থনীতির কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না কোনো সমন্বিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাত্ত।
রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে দেশে দেশে ছুটে বেড়িয়েছিলেন তিনি। জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে রচনা করেন বাংলাদেশের সংবিধান।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেন। নবগঠিত বাংলাদেশে বিভিন্ন সমস্যা, অভাব, বিভিন্ন সেক্টরে অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি ও বামপন্থি বিদ্রোহসহ দেশব্যাপী নানা ধরনের অস্থিরতার মধ্যেও তিনি দৃঢ়তা, অবিচলতা, সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কঠোর হস্তে পরিচালনা করে এই দেশ।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, ধৈর্য ও অবিচলতার ব্যাপারে গর্ব করে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ’আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। পর্বততুল্য ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতাসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু দেশ ও জাতিকে অনেক বেশি ভালোবেসেছিলেন।’
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ আবার তার দুর্বল দিকের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি’।
এরপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের হাল ধরেন তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশ এখন ডিজিটাল। উন্নয়নের মহাসড়কে ভাসছে বাংলাদেশ। গেল এক দশকে দেশের উন্নয়নের ঝুলিতে যোগ হয়েছে অনেক কিছু।
এরই মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আমাদের জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা এখন ৮.২।
মহাকাশের কক্ষপথ জুড়ে এখন অবস্থান করছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে স্পেসএক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে উড়ে ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর এর নিয়ন্ত্রণ করতে গাজীপুরের তেলীপাড়া ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় স্থাপন করা হয় গ্রাউন্ড স্টেশন।
চলতি বছরই বিজয়ের মাসে ৪১ তম স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিলোমিটারের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতু চালু হলে একদিকে যেমন কমবে দেশের মানুষের ভোগান্তি, তেমনি বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে অর্থনীতির উন্নয়নের মহাশিখরে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে, সহজ হবে মানুষের চলাচলও।
সরকারের আরেক মেগা প্রকল্প হচ্ছে মেট্রোরেল ব্যবস্থা। ২০.১ কিলোমিটারব্যপী একটি মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মানুষের জীবন অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
এদিকে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত হয়েছে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরের কারণে দেশের সমুদ্র অঞ্চলে পণ্য সরবরাহ অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে।
বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ফেনীর সোনাগাজী ও চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুন্ড উপজেলা নিয়ে স্থাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে স্থাপিত এ শিল্পনগরে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সমুদ্র বন্দর, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি শোধনাগার, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। এটিও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বতি করবে।
এছাড়া বাস্তবায়নাধীন মহাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, এমআরটি-৬ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প, রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি।
মূলত স্বাধীনতা এবং বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ‘ভিশন-২০২১’ এর স্লোগানে এই মহা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
মুদ্রার যেমন এক পিঠ আছে, তেমনি ওপিঠও আছে। একদিকে যেমন আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছি, দেশে সমস্যাও আছে অনেক কিছু। দেশে এখনো নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় নি। প্রতিনিয়তই দেশে ধর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। মেয়েরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়।
এছাড়া দেশে হত্যা, খুন, ধর্মকে ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টিসহ নানা প্রতিবন্ধকতা লেগেই আছে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের পন্থা বের করা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেও। কেননা জনতাই হলো একটি দেশের প্রাণ। তাহলেই এতো শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।