fbpx

মহান বিজয় দিবস : বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

‘সাবাস বাংলাদেশ ! এ পৃথিবী

অবাক তাকিয়ে রয়

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার

তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

কবি সুকান্ত যথার্থই বলেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, তার নব উদয় হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

দীর্ঘ ৮ মাস ২১ দিনের সশস্ত্র সংগ্রাম করে লাখো প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিন বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের রক্তিম সূর্য। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম হয়। আজ বুধবার সেই বিজয়ের শুভক্ষণের ৪৯তম দিন। মহান বিজয় দিবস পালনে যেন নতুন সাজে সেজেছে বাংলাদেশ। ৫০তম বছরে পা রাখতে চলেছে প্রিয় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে বাঙালি জাতি।

এবারের বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কারণ এই ৪৯ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। কখনো সামনে এগিয়েছে, আবার কখনো পিছিয়ে গেছে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে। তবুও দমে যায়নি জাতি। শত বাধা উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়। সেই সাথে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের ঢেউ লেগেছে সারাদেশে।

বস্তুত বাংলাদেশের এই বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এই জাতির রক্ত ঝরানো সংগ্রাম। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি রক্ত দিয়েছে। লড়াই করেছে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। সোয়া ২শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে এই বাঙালি জাতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনেও ছিলো বাঙালির অবদান। বাঙালিরাই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর। কিন্তু কয়েক বছরেই বাঙালির স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। যে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ইংরেজদের বিতাড়িত করেছিল সেই একই রকম শোষণ বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে পড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই।  শুরু হয় সংগ্রামের নতুন যুগ।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে’৪৮-এর বাংলা ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ৫৮-এর মার্শাল-ল বিরোধী আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর রক্তঝরা গণগভ্যুত্থান, ৬ দফা ভিত্তিক ৭০ এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, নির্বাচন পরবর্তী ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করতে থাকে। ফলে শুরু হয় এক অসহযোগ আন্দোলন। তবে সব ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা আর মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত ঢেলে দিয়ে বীর বাঙালির বিজয়।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ অস্বীকৃত ছিল। তখন বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘যার যা কিছু আছে’ তা নিয়েই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়েছিলেন। যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে জাতিকে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাক সৈন্য অস্ত্র সমর্পণ করেছিল বাঙালি জাতির বীর সেনানিদের কাছে।

নিয়াজীর অনুরোধে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকী বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন। ১৫ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার চারপাশে অবস্থান নেয়। নিয়াজি মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতের কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ভারত তা প্রত্যাখান করে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের দাবী জানায়। ভারতের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয় ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫ টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টা পর্যন্ত আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য বিমান হামলা বন্ধ থাকবে। আত্মসমর্পণের আলোচনার জন্য যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম যোগাযোগ করেন মেজর জেনারেল নাগরা।

এদিকে ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জুলফিকার আলী ভুট্টো এক নাটকীয় ভাষণ দেন। এই ভাষণের পর তিনি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেন। ১৬ ডিসেম্বর সকালে বিমানাক্রমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলীর মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ৬ ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ জানান যাতে অস্ত্র সমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়। এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে অবশ্য মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন এবং সেখান থেকে জেনারেল নাগরা নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের আহবান জানান।

নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার পর সকাল ১০ টা ৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব মধ্যাহ্নে ঢাকা এসে পৌঁছেন। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটেলিয়ান সৈন্য ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে জয় বাংলা মুখরিত মানুষের ভিড়ে।

বিকেল ৪টায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে খন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকা অবতরণ করেন। কিছু পরেই ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গণে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন।

মেজর হায়দার নিয়াজীকে আত্মসমর্পন স্থানের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কাঠের টেবিল ও দুইটি কাঠের চেয়ার ছিল। আরোরা টেবিলের ডানদিকে এবং নিয়াজী বাম দিকে বসেছিলেন। সে সময় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৮-১০ লাখ বাঙালি উপস্থিত ছিলেন।

পাক সেনানায়ক মেজর জেনারেল জামশেদ প্রথম আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার বিকাল ৪.২০ মিনিটে সারেন্ডার পত্রের নিচে ডানদিকে ১ মে নিয়াজী পরে বামদিকে জগজিৎ সিং আরোরা স্বাক্ষর করেন। সামরিক বিধি অনুযায়ী বিজীত সৈনিকের একটি দল এ সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ঐ দিনই ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের সূচনা ঘটে।

প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পন করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পন অনুষ্ঠান। ২ লাখ ৩৮ হাজার পাক সৈন্য আটকা পড়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্খিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর ২৬৬ দিন পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পন করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন-আব্দুল করিম খন্দকার (বিমান বাহিনীর প্রধান)। গণবাহিনীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন- বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী।

২২ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর তখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি যথাযর্থ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।

পরিশেষে বিজয়ের ৫০ বছরে আমাদের অঙ্গীকার হোক এই- যে চেতনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আপামর জনসাধারণ, তার বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা নিয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে নতুন প্রজন্ম- এই হোক বিজয় দিবসের প্রত্যয়। দেশের সব মানুষের শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থান নিশ্চিত হোক। স্বাধীনতাহীনতায় কেউ থাকবে না। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক স্বাধীনতার সুফল, সুষমভাবে।

খালিদ সাইফুল্লাহ

লেখক, প্রকাশক ও গবেষক।

Advertisement
Share.

Leave A Reply