fbpx

মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরুক সদিচ্ছায়

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

দেশ থেকে আনা লুঙ্গি পরে চাণক্যপুরীর তপ্ত গরমে আরামে একটা দিন কাটালাম। গড়ে ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস চলছে তাপমাত্রা। এই গরমে আরামে থাকতে লুঙ্গির কোন বিকল্প নাই। দিনভর ক্যাম্পাসে একটু ঘোরাঘুরির পর সন্ধ্যায় ইয়াশ্যন্ত প্লেস-এ গণ-ইফতারে যোগ দিয়েছি লুঙ্গি পরে। এরপর চাণক্য কর্নারে বন্ধুদের সঙ্গে চা খেয়ে একটু বিশ্রাম। তারপর ডাল দিয়ে দুইটা রুটি মুখে পুরে তারাবির নামাজ পড়তে গেলাম সুদান দূতাবাস মসজিদে।

(২৭-শে এপ্রিল, ২০২২) একটুখানি পড়াশোনার মাঝে এখানে-ওখানে যাওয়া-আসায় হালকা সবুজ, আকাশি ও বাদামি ছাপের লুঙ্গিটি নজরে পড়েছে অনেকের।

দুপুরে ভুটানের এক বন্ধু বললো, ‘দাদা, ভালো লাগছে। অন্য বাঙালিরা কেন এটা পরে না?’ আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘আমিতো জানি না। আমার মন যা চায়, আমি তাই পরি।’

আমাদের গ্রন্থাগারিক স্যার, যিনি বাংলাদেশি। জোহরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে আসার পথে উনি বললেন, ‘লুঙ্গির রংটা আকর্ষণীয়।’

বিকেলে ক্যাম্পাসের ভেতর এক ভারতীয় মেয়ে শিক্ষার্থী বলল, ‘গরমে এটা পরা আরামদায়ক, তাই না?’
উত্তরে বললাম, ‘হ্যাঁ। তবে শামলানোটা একটু মুশকিল।’ কারণ, প্রায় কয়েক বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো লুঙ্গি পরে চাণক্যপুরীতে মহড়া দিলাম।

তার সাথে থাকা নেপালের একজন কয়েক সেকেন্ড ধরে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি দেখে বললো, ‘সুন্দর লাগছে। কোথায় পাওয়া যায় এটি (লুঙ্গি)?’ বললাম, ‘বাংলাদেশ থেকে এনেছি।’
ইফতারের সময় ভারতীয় এক বাঙালি চাচা বললেন, ‘ভালোতো লুঙ্গিটা।’
আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে এনেছি।’
শুনে উনি বললেন, ‘আমার একটা লাগবে। তুমি দেশে গেলে আমার জন্য একটা আনবে। উনি আগেও কাউকে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি আনিয়েছেন। ওনার মতে, বাংলাদেশের লুঙ্গি আরামদায়ক। আর এতোটাই হালকা যে, পুরো লঙ্গিটা মুড়িয়ে দু হাতে রাখা যায়। আমার শুনে ভালো লাগলো। আমি বললাম, ‘আমি দেশে গেলে আপনার জন্য নিয়ে আসবো।’

মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরুক সদিচ্ছায়

রাতের খাবারের সময় মেসের প্রধান বার্বুচি দেখে হেঁসে দিয়ে বললেন, ‘ক্যায়া বাদ হে!’ আমি বললাম, ‘ক্যায়সে লাগরাহে? (কেমন লাগছে?)’ উনি বললেন, ‘বাড়িয়া (খুবই ভালো)।’
উনি জানালেন, পাকিস্তানের পাঞ্জাব অংশের মানুষজনও নাকি এরকম লুঙ্গি পরেন। ওনার মতে, এই পোশাকে (লুঙ্গি-পাঞ্জাবিতে) আমাকে ওদের (পাঞ্জাবিদের) মতো লাগছে। আমার এ তথ্য জানা নেই, পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরাও লুঙ্গি পরে। তবে, লুঙ্গি দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পুরুষদের একটি পোশাক। কোথাও কোথাও নারীরাও লুঙ্গির মতো কাপড় শরীরের নিচের অংশে পরে থাকেন। মিয়ানমারেও এটি লুঙ্গি হিসেবে পরিচিত।ভারতের দক্ষিণাঞ্চলেও পুরুষেরা লুঙ্গি পরেন। তাদের লুঙ্গির ধরন ও পরার ধরন আমাদের থেকে আলাদা।

তারাবির নামাজের পর সুদান দূতাবাসে ওই চাচা ও এক বন্ধুর সাথে থাকা তার বাবার সঙ্গে দেখা হলো। সালাম-কুশল বিনিময়ের পর আমার বন্ধুর বাবাকে বাঙালি চাচা বললেন, ‘দেখছেন, ওর লুঙ্গিটা কী সুন্দর?’
এ দুই চাচা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত মিশর দূতাবাসে কর্মরত। আমার বন্ধুর বাবা লক্ষ্ণৌয়ের মানুষ। বাঙালি চাচা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার জন্য একটা (লুঙ্গি) নিয়ে আসবে, কেমন। সঙ্গে জানালেন ওনার পছন্দের রং- সাদা। আমি বললাম, ঠিক আছে। উনি তখনই বললেন, ‘তোমার পে-টিএম বা ইউপিআই আছে?’

তৎক্ষণাৎ টাকা লেনদেন করা যায় এসব অনলাইন সেবায়। আমি বললাম, ‘লাগবে না।’
উনি বললেন, ‘একটা নয়; আনলে দুটো আনতে হবে।’ দ্বিতীয় লুঙ্গিটি লক্ষ্ণৌই চাচার জন্য। আমি বললাম, ঠিক আছে। ওই চাচাও বললেন, সাদা রংয়ের লুঙ্গির কথা। তবে, ছোট ছোট চেকেরও লুঙ্গি তিনি পরেন।

এরপর নেহেরু পার্কের মধ্যে হেঁটে আসার সময় সাথে থাকা ছোট ভাই মহিউদ্দিনকে বললাম, ‘এই লুঙ্গি দিয়েই বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করে ফেললাম।’

আর আমার মনে হলো, আমি যতই চিন্তা-চেতনায় নিজেকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলি, পোশাক আর খাবারে আমি চিরদিনই বাঙালি, বাংলাদেশি।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে সাত বছর ধরে অধ্যয়ণ করছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ২০১৫-২০১৭ মাস্টার্স, এরপর ২০১৭ থেকে ২০১৯ এমপিল সম্পন্ন করি। একই বিভাগ থেকে চলছে পিএইচডি। এই সাত বছরে অধিকাংশ সময়ই আমি বাংলাদেশি পোশাক পরেছি। যেবারই দেশে যেতাম নিয়ে আসতাম পছন্দের পাঞ্জাবি, বানিয়ে নিয়ে আসতাম শার্ট-প্যান্ট।

গত দু বছর ধরে যাওয়া হয়নি তাই বাংলাদেশি পোশাকের সংখ্যাটা কমে গেছে। নিয়মিত পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দেখে বন্ধু-সহপাঠী এমনকি কিছু শিক্ষকের কাছে আমার একটি বিশেষ ছবি তৈরি হয়ে গেছে। জিন্স, টি-শার্ট বা কখনো হাফ প্যান্ট পরা দেখলে তার একটু বিস্ময় প্রকাশ করেন। কোভিডের আগে আমার এক শিক্ষক এক কনফারেন্সের দিন পাঞ্জাবি পরে আসেন। ভারতে পাঞ্জাবিকে কুর্তা বলে। উনি কুর্তা দেখিয়ে মজা করার সুরে বললেন, ‘আই অ্যাম গিভিং এ কমপিটিশন টু ইউ টুডে।’

আমি হাসলাম। আরেক দিন লিফটে করে রুমে আসছিলাম। অর্থনীতি বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষক বললেন, ‘তুমি বাঙালি’ ওনার সাথে আমার আগে কখনও কথা হয়নি। তাই আমি একটু হচকিত হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। আপনি কীভাবে জানেন। উনি আঙ্গুলি দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার কুর্তা।’

আমি হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালাম ওনাকে।

ভক্ত না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু-বান্ধবী আমার পোশাক-সচেতনতা বা স্টাইল কনসাসনেসের প্রশংসা করে। তেমন পরিচিত না হলেও পাঞ্জাবির কারণে অনেক মেয়ের সাথে আমার কথা হয়। পোশাক নিয়ে ছোট-ছোট কথা বলা শুরু থেকে পরিচয়ও হয়ে ওঠে তাদের সঙ্গে।

তবে, আমার পোশাক সচেতনতার ভক্তও রয়েছে। মহশ্বের গিরি অর্থনীতি বিভাগের একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী। সে নেপালি। আমাকে পাঞ্জাবি পরা দেখে দেখে সে-ও পাঞ্জাবি কিনেছে। অনেক দিন বলবে বলবে করে, একদিন বলেই ফেললো:
‘শরিফ ভাই, আ রিয়েলি লাইক ইউর ফ্যাশন সেন্স। আই হ্যাফ বট টু কুর্তা আফটার সিয়িং ইউ অলওয়েজ ওয়্যারিং কুর্তা। (শরিফ ভাই, আমি তোমার পোশাক সচেতনা পছন্দ করি। তোমাকে সবসময় কুর্তা পরা দেখে আমিও দুইটি কিনেছি।’

এ লেখা লেখার সময় মনে পড়লো ন্যান্সি ফ্রেসারের স্বামীর কথা। রেস, এম্পায়ার ও ক্যাপিটালিজমের সংযুক্তি নিয়ে তাত্ত্বিক বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত ছিলেন ন্যান্সি ফ্রেসার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আয়োজনে এ অনুষ্ঠান হয় ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে, ২০১৮ সালের মার্চে। সেসময়কার সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন শশাংঙ্ক পেরেরা ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রবি কুমার আমাকে দায়িত্ব দিলেন ন্যান্সি ফ্রেসারকে হোস্ট করার। সঙ্গে ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের সেই সময়ের পিএইডি গবেষক পুজা কলিতা। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে দেখা ও কথা হয় ন্যান্সি ফ্রেসারের স্বামীর সঙ্গে। জিন্স ও শার্ট পরা মার্কিন ওই ব্যক্তি দুইবার আমার কুর্তার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আই লাইক ইট।’

মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরুক সদিচ্ছায়আমার পাঞ্জাবি দেখে এ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের প্রশংসা পেয়েছি, পেয়েছি তাদের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঞ্জাবি নিয়ে আসার প্রস্তাব। ভিনদেশিদের কাছে নিজ দেশের জিনিসের প্রশংসা শুনলে মনটা ভরে যায়, বেড়ে যায় ভালোবাসা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুঙ্গি পরে ঘুরতে পারিনি। লুঙ্গি পরে ঘোরাটা অনেকটা সেখানার আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না, বোধ হয়। একদিন একই ধরনের একটি লুঙ্গি পরে রুম থেকে নিচে নেমেছিলাম। সেটি লক্ষ্য করেছেন আমার কাছের দুই বড়ভাই। তারা ভালোবাসার সুরে আমাকে বুঝিয়েছেন, ‘এখানে লুঙ্গি পরে নিচে বা হলের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়।’

তারা হয়তো ঠিকই ছিলেন। কেননা, ঢাকায় লুঙ্গি পরাটাকে ‘ক্ষ্যাত’ হিসেবে দেখা হয়। কয়েক বছর আগে গুলশান-বনানী এলাকায়-তো নিয়ম করে রিকশাচালকদের একসময় লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরাতে বাধ্য করা হলো।

অনেক সময় আমি সচেতনভাবে আমাকে নৃ-তাত্ত্বিকভাবে একরোখা বা জাত্যাভিমানী ভাবী। সেটি পোশাকের ক্ষেত্রে, এবং খাবারের ক্ষেত্রে। আজ আর খাবারের কথা নয়, আরেকদিন। কেননা, অনেক সময় পোশাকই বহন করে পরিচয়। একে-৪৭ ম্যুভির একটি সংলাপ, ‘অ্যাপারেল অফেন প্রোক্লেইম্স দ্য ম্যান(পার্সন)।’

তবে, আমি এটিও জানি, পোশাক দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত নয়। তবে, এটিও সত্য, পোশাকই অনেক সময় ব্যক্তির পরিচয় হয়ে ওঠে। পোশাকি অধিকার হয়ে ওঠে মৌলিক অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার। এ অধিকার চাপিয়ে দেয়া যেমন যায় না, তেমনি দাবায়ও রাখা যায় না।

আজকের এ লেখার শেষ প্রান্তে, আমার কামনা- বিশ্বের সব মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরুক সদিচ্ছায়। অন্যের হুমকি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাক পোশাকি সভ্যতা। প্রতিষ্ঠা পাক সবার প্রতি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

শরিফুল ইসলাম
পিএইডডি গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নিউদিল্লি।
ই-মেইল: [email protected]

ঢাকা টু দিল্লি, আমার দৌড়ের জীবন : শরিফুল ইসলাম

Advertisement
Share.

Leave A Reply