রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে সিটিপি (ক্লাস টিচার্স পিরিয়ড) বলে সপ্তাহে দুটো ক্লাস এর সময় বরাদ্দ ছিলো। একদিন আমরা পুরো ক্লাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে. বেল্ট জুতো ঝকঝকে করে, হাত এর নখ কেটে, সুন্দর করে চুল আঁচড়ে, টাইএর নট বেঁধে অপেক্ষা করতাম। বিচারকরা ঘোষণা করতেন সাপ্তাহিক অ্যাসেম্বলীতে সেই সপ্তাহে কোন ক্লাস ঝকঝকে তকতকে থাকার প্রতিযোগিতায় জিতেছে। আরেকদিন আমরা সহপাঠ্য বিষয়গুলির চর্চা করতাম। বক্তৃতা , বিতর্ক, হবি, কবিতা, গানের পরিবেশনা হতো।
আমাদের ক্লাসে এসে যোগ দিয়েছিলো এক ছেলে তাকে আমরা আজম ডাকতাম। সে সিটিপিতে চমৎকার হ্যাট আর কোট পরে আসতো। হ্যাট থেকে খরগোশ বের হতো, বের হতো চকলেট। স্ট্রিং ম্যাজিক, কনজ্যুরিং সে খুব ভালো পারতো। পয়সা লুকিয়ে ফেলতো হাতে, দড়ি কেটে কেটে অসমান করে দুটো দড়ি কে পরে সমান করে ফেলে আবার জোড়াও দিয়ে দিতো।
আমি ছোটবেলায় পিসি সরকারকে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি সেই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। কেমিক্যাল ম্যাজিক নামে একটা বই পাঠিয়েছিলেন। আমি কিন্তু ছোট বড় বেশকিছু জাদু জানি , দেখাতেও পারি। শুভেচ্ছায় বহু বড় ম্যাজিক আমি শাহীণ শাহ ও এস রহমানকে বানাতে সাহায্য করেছি। যার মধ্যে ছিল ইলাস্টিক লেডি ও ইমপেল সহ বেশ কয়েকটি জাদু। জাদু নিয়ে আমার আগ্রহ খুব ছোটবেলার।
তারপর আমি চলে গেলাম মেডিকেলে। আজম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি মাঝে মাঝে তাকে দেখতাম। মিছিল করছে। নীলক্ষেতের দিক থেকে টিএসসির দিকে আসছে। ছাত্রদলের মিছিল। এরশাদের বিরুদ্ধে শ্লোগাণ।
দূর থেকে হাত নাড়তাম। ইচ্ছা করেই দূরত্ব তৈরী করেছিলাম। আমি ঢামেকসুর ছাত্রলীগ সমর্থিত নির্বাচিত সদস্য। সে করে ছাত্রদল। তারপর ১৯৯২ সালের শুরুতে তার সাথে একদিন দেখা। এরশাদের পতন হয়েছে। আমি শাহবাগ থেকে বাসার দিকে বাসে চড়েছি, একদম পেছনের সিটে। পাশেই দেখি আজম। আমি তার সাথে কথা বলছি, সেও। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি আজম? জাদু দেখাও। সাথে কি তাসের প্যাকেট আছে।
সে ম্লান হাসি হেসে শার্ট উঁচু করে পিঠ ও পেটে বিভৎস কাটা দাগ দেখিয়ে বললো, বন্ধু, আমি তো এখন এই জাদু দেখাই। প্রতিপক্ষের কোপের দাগ। সেলাইয়ের দাগ ম্যাপের ওপরে রেললাইনের মতো। মেডিকেল কলেজে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। তারপরেও নিজের ছোটবেলার বন্ধুর শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখে মন খারাপ হলো, একটু আঁতকেও উঠেছিলাম।
আমি কথায় কথায় বললাম , হোস্টেলে বালিশের নিচে ম্যাজিক রোপ নিয়ে ঘুমাতে। জাদুর প্র্যাকটিস করতে। এখনো কি বালিশের নিচে দড়ি নিয়ে ঘুমাও?
সে আবার বিষন্ন হাসি হেসে বললো, না তুষার। বালিশের নীচে যন্ত্র রাখি। কখনো রিভলভার কখনো পিস্তল। বলে সে ফার্মগেটে নেমে গেলো।
৯২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর , আমার প্রফেশনাল পরীক্ষা চলছে। রিটেন দিতে যাবো প্যাথলজির। প্রফের দিন কয়েক আগে থেকে আমি পড়তাম না। মাথা ঠান্ডা করে স্বাভাবিক দিন যেভাবে কাটে সেভাবে চলতাম। ভোরে ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করে কমনরুমের সামনে টেবিলে পিন করে রাখা পত্রিকা পড়তে গিয়ে দেখি , প্রথম পৃষ্ঠায় আজমের ছবি। নীচে লেখা মামুন। সূর্যসেন হলের পানির ট্যাংক থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাকে ইলিয়াস আলী গ্রুপ হত্যা করেছে। পরে কেউ কেউ বলেছে , তাকে ও তার সাথে আরেকজনকে ইলিয়াস আলী নাকি নিজেই গুলি করে হত্যা করেছিলো। সত্য মিথ্যা জানি না।
আজমের নাম যে মামুন সেটাও জানতাম না।
পরীক্ষা দিতে চলে গেলাম। সেই প্রফেশনালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকাতেও থাকলাম। কিন্তু খুব মনখারাপ নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম সেদিন। ছবি আঁকার সময় লাল রং কে রক্ত মনে হচ্ছিল।
আমি যখন আমার বন্ধু আজমকে মনে করি তখন হ্যাট থেকে কবুতর আর খরগোশ, ক্যান্ডি, তাসের প্যাকে সব তাস, রানীর ছবিতে বদলে যাওয়া আর দড়ির খেলা মনে পড়ে। মনে পড়ে সে বলতো সে জুয়েল আইচের মতো জাদুকর হবে।
আমি একটা গল্প লিখেছিলাম মামুনের কথা মনে করে।
গল্পটা আমার জমানো কাগজের মধ্যে রয়ে গেছে। গল্পটা আপনাদের জন্য এখানে কয়েক ধাপে লিখে পড়তে দেবো।
আমার মাঝে মাঝেই আজম (মামুন) কে মনে পড়ে। কালো কোট এ সাদা কলার দেয়া, কোটের ফোল্ড থেকে পয়সা বের হচ্ছে , সেটা সে ভ্যানিশ করে দিয়ে আমার কান এর পেছন থেকে বের করছে।
হয়তো সে সত্যিই বড় জাদুকর হতো। শুভেচ্ছাতে জাদু দেখাতো। হয়তো এখন অর্ধশতকের জীবনে আমরা দুজন বসে বসে জাদুর খেলা নিয়ে গল্প করতাম।
আব্দুন নূর তুষার। জন্ম ঢাকায়, জন্ম তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। পেশাগত জীবনে ডাক্তার। তবে তিনি উপস্থাপক হিসেবেই পরিচিতি পান।