আপনি বয়সে বড় কাউকে বিয়ে করলে টাকার জন্য বিয়ে করেছেন। ছোট কাউকে বিয়ে করলে আপনার চরিত্রে সমস্যা। আবার, সমবয়সী কাউকে বিয়ে করলে আপনার বিয়ে টিকবে কতদিন সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকেন সবাই।বিয়ে আপনি করলেও আপনার সাথে আপনার সঙ্গীর বয়সের ফারাক নিয়ে এতো সব গাল-গল্প সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে যে আপনি নিজেই হয়তো নিজেকে প্রশ্ন করে ফেলতে পারেন।আপনার একান্ত ব্যক্তিগত এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কেউ যে কথা বলার অধিকার রাখেনা এই সহবত শিক্ষাটুকু এই দেশের মানুষের অনেকেরই একেবারেই নেই।
সাধারণ মানুষ হলে তো পার পেয়েই গেলেন কিন্তু সেলেব্রিটি হলে কি সেই উপায় থাকে? উপায় ছিলোনা আজমেরি হক বাঁধনের ক্ষেত্রেও।
অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন তার একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন ‘আমি একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষকে বিয়ে করতে চেয়েছি।আমার পরিবারে কেউ মিডিয়ার সাথে পরিচিত নন, এখানে কাজ করেননি। মিডিয়ায় কাজ করাকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হয় না। আমি জানতাম আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে তাই প্রতিষ্ঠিত একজন পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।’
বাঁধন যে বাঁধন বেঁধেছিলেন একেবারেই সংসারের বাঁধন তৈরি করতে সেটি তিনি প্রমাণ করেছিলেন সেই ২০১০ সালে চলা ৯টি সিরিজের লিড কাস্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে। বিয়ের মাত্র ২মাসের মাথায় জীবনে আরেকজনের উপস্থিতি তিনি চেয়েছিলেন এই বাঁধন শক্ত করতেই।
আজমেরি হক বাঁধনের সাবেক স্বামীর সাথে বয়সের বিশাল ফারাকের জন্য যত কটু কথা তিনি শুনেছেন তার চেয়েও ভালো কথা তিনি শুনতেই পারতেন যখন এই এক সংসারের জন্য তিনি নিজের ক্যারিয়ারের সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলেন।
টাকার জন্য বিয়ে করেছে এই প্রশ্নবানে বাঁধনকে জর্জরিত হতে হয়েছে অসংখ্যবার। অথচ তাদের একমাত্র সন্তান হবার পর থেকে স্ত্রী কিংবা সন্তানের ভরণপোষণের জন্য একটি পয়সা সাবেক স্বামীর থেকে পাননি বলেও জানান বাঁধন। ছয় বছরের শিশুকন্যাকে সাবেক স্বামীর বর্তমান স্ত্রী ও সাবেক স্বামী নিজে আটকে রাখলে বাঁধনের জীবনের অন্যতম কঠিন লড়াই শুরু হয় আর সেটি, ‘আইনের লড়াই’।
এই কাস্টোডি নেয়ার যুগে যেখানে কাস্টোডি নেয়াকেই নারীরা বিশাল জয় মনে করেন সেখানে বাঁধন আরো একবার অনন্য হয়ে প্রমাণ করলেন ‘না, টাকার জন্য নয়। নিজেকে কোনো এক শেকল থেকে মুক্ত করতেই বাঁধন বেছে নিয়েছিলেন এই জীবন। যে জীবন তাকে দিয়েছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ এক সম্পদ, তার কন্যা। বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে পুরোটা জীবনই।’
কাস্টোডি নয়, মেয়ের পুরো অভিভাকত্ব বাংলাদেশে প্রথম কোনো নারী হিসেবে পেয়েছিলেন আজমেরি হক বাঁধন। মেয়েকে পেতে দেনমোহর এবং ভরণপোষণ এর মামলা প্রত্যাহার করে নেন তিনি। বাঁধন, নারীদের সকল বাঁধন তুচ্ছ্য করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এক মায়ের ও উদাহরণ তৈরি করেন সেদিন। এই সবকিছুর মাঝেও কন্যাকে বাবা থেকে আলাদা করতে পারতেন কিন্তু তারপরেও তার কন্যার পিতার জন্য সবসময় দেখা করার সুযোগটি তিনি খোলা রেখেছেন।
কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসব। সেই উৎসবে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ও বাঁধন অভিনীত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেয়ে ইতিহাস গড়েছে।.
কানে বাংলাদেশ থেকে এর আগে প্রয়াত তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ২০০২ সালে ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে স্থান পেয়ে ফিপরেস্কি পুরস্কার জেতে। উৎসবটির আয়োজকদের স্বীকৃত প্যারালাল বিভাগ এটি।
ঢাকাইয়া জামদানীতে পুরো ডবসি থিয়েটারে নিজের দেশের ঐতিহ্য আর দেবীর মতো সৌন্দর্যের সাথে দ্যুতি ছড়ায় বাঁধনের অভিনয়। সিনেমা শেষে সিনেমা ক্রিটিকদের দাঁড়িয়ে হাততালিতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন আমাদের অতি আপন আজমেরি হক বাঁধন।
জীবনের ৩৭টি বসন্তের সাথে বাঁধন জীবনের চরম খরার সময়গুলোও দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ” বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ” থেকে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হওয়া প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষায় চতুর্থ হন তিনি। সমস্ত ঝড় সামলে তবুও দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, হতাশা, প্যানিক এট্যাককে প্রবল মনোবলে হার মানিয়ে নিজেকে সময় দিয়ে নিয়ে গেছেন সৌন্দর্যের অনন্য উচ্চতায়। সোশাল মিডিয়ার শত শত বুলিং, অজস্র গালিগালাজ, ব্যক্তিজীবন নিয়ে মানুষের অহেতুক টানা হেঁচড়ার পরেও বাঁধন নিজে দাঁড়িয়ে থাকার সাথে সাথে দাঁড় করিয়েছেন অন্যতম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এক হল ভরা সবাইকে কেবলই নিজের অভিনয় দক্ষতায়।
২০০৬ সালে আসা এই লাক্স সুপারস্টার সত্যিকার অর্থেই একজন সুপারস্টার নারী, সুপারস্টার মা,সুপারস্টার শিক্ষার্থী, সুপারস্টার অভিনেত্রী। অসংখ্য ঘৃণা, কটুকথা, বাজে মন্তব্য, হতাশা সবকিছু ডিঙ্গিয়ে আমাদের গৌরব এনে দেয়া, আমাদের সুপারস্টার আজমেরি হক বাঁধন।