fbpx

আব্বাসউদ্দীনের প্রয়াণ দিবস

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

যার গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…’ ছাড়া উৎসব শুরু হয়না সেই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত জগতে মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত আব্বাসউদ্দীন আহমদের ৬১ তম প্রয়াণ দিবস এই ৩০ ডিসেম্বর। ১৯৫৯ সালের এ দিনে চিরবিদায় নেন তিনি। মাত্র ৫৮ বছরের জীবনে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন যে অবদান রেখে গেছেন, তা অহর্নিষ বাঙালি স্মরণে রাখে।

১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বলরামপুর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ হাইস্কুল থেকে আব্বাসউদ্দীন ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। কিন্তু এখানে বেশি দিন থাকা হয়নি। রাজশাহী কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন কাছের শহর কুচবিহার কলেজে। ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তবে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতায় চলে যান।

১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন আব্বাসউদ্দীন। সে সময় আব্বাসউদ্দীনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ছোটবেলা থেকেই ছিল তার গানের তৃষ্ণা। গানের জগতে ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। আপন প্রতিভাবলে তিনি সবার সামনে উদ্ভাসিত হন। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগাঁয়ের একজন গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত রপ্ত করেন।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসার পর সঙ্গীত জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। শুধু গায়কই ছিলেন না। তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গেয়ে আব্বাসউদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি-সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামী সংগীত, পল্লীগীতি ও উর্দুগান গেয়েছেন তিনি।

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। তিনি যে সময় গান শুরু করেন সে সময়টা ছিল বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণের প্রহর। তাই আব্বাসউদ্দীন আহমেদকে বলা যায় নবজাগরণের শিল্পী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য মুসলমান কবি-সাহিত্যিক তাদের রচনা দিয়ে মুসলিম চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কুচবিহারে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের প্রথম পরিচয় হয়। নজরুলও খুব স্নেহ করতেন তাকে। কবি সবার কাছে আব্বাসউদ্দীনকে পরিচয় দিতেন ‘আমার ছোটভাই’ বলে। প্রায় ২০ বছর তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহচর্যে ছিলেন। নজরুল- আব্বাস জুটির অনেক গান রেকর্ড হয়ে তুমুল সাড়া ফেলে।

আব্বাসউদ্দীন ছিলেন প্রথম মুসলিম গায়ক, যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবেও খুব সফল। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামী ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।

একটি গান শোনা মাত্র আব্বাসউদ্দীন সুমধুর কণ্ঠে তা আয়ত্তে নিতে পারতেন। জাতীয় কবির বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে…’ গানটি প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। যে গানটি ছাড়া রোজার ঈদকে ঈদই মনে হয় না। গজলেও তিনি অতুলনীয়। ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের…’ নজরুলের এই বিখ্যাত গানগুলোর শিল্পীও আব্বাসউদ্দীন আহমদ।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দফতরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আব্বাসউদ্দীন ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেন।

গায়ক ছাড়াও আব্বাসউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন অভিনেতাও। তিনি মোট চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এগুলো হলো-‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’ (১৯৪০)। ঠিকাদার ছবিতে আব্বাসউদ্দীন একজন কুলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এসব সিনেমায় তিনি গানও করেছিলেন। তখনকার দিনে মুসলমান ব্যক্তির সিনেমা করা ছিল এক ব্যতিক্রম ঘটনা।

আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা গানের সংখ্যা প্রায় ৭০০। ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই’, ‘তোরষা নদী উথাল পাতাল, কারবা চলে নাও’, ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’, ‘মাঝি বাইয়া যাও’, ‘নাও ছাড়িয়া দে’, ‘ওই শোন কদম্বতলে’, ‘ও ঢেউ খেলেরে’, ‘নদীর কূল নাই’, ‘একবার আসিয়া সোনার, আল্লাহ মেঘ দে, আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি, ও কী ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে- সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কণ্ঠ দেন এই শিল্পী। তার লেখা ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ (১৯৬০) একটি মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ আত্মচরিত গ্রন্থ। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হন।

 

Advertisement
Share.

Leave A Reply