fbpx

উম্মে ফারহানার গল্প

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান উম্মে ফারহানা। ময়মনসিংহ শহরে জন্ম। ২০১৬ বইমেলায় ‘চৈতন্য’ থেকে ‘দীপাবলি’ নামে তার প্রথম গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল। বিবিএস বাংলার পাঠকদের জন্য থাকছে এই লেখকের নতুন গল্প ‘দরজা’।

যে কোন জায়গায় যাওয়ার জন্য রওনা করার আগে আমি সাধারণত বাথরুম হয়ে আসি। রাস্তাঘাটে হিসু পাওয়া খুব জঘন্য ব্যাপার, আমার ইউরিন ইনফেকশন আছে বহুদিন ধরে, মাঝেমধ্যে হাঁচির সঙ্গে একটু প্রস্রাব এসে যায়, কাপড় নষ্ট হয়। তাই কোন ঝুঁকি নেই না। আজকে অনেকক্ষণ বাইরে ছিলাম, অনেকক্ষণ ধরেই প্রস্রাবের বেগ চেপে রেখেছিলাম। বাসায় এসে দেখলাম যা ভেবেছি তাই, বাথরুম বন্ধ। দোতলার বাথরুম মেজো ভাবী একাই ব্যবহার করে,আমরা কেউ সেখানে যাই না, নিচতলার বাথরুমে বড় ভাইয়া গোসলে ঢুকেছে। আমি ভদ্রতার তোয়াক্কা না করে দরজায় টোকা দিলাম, ভাইয়া বলল দেরি হবে। বড় ভাইয়া কথাবার্তা খুব কম বলে, আমরা সবাই তাকে বেশ ভয় পাই। বাথরুমে টোকা দেওয়ার ফলে সে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি দরজা ভাঙা বাথরুমের দিকে এগোলাম।

এটা এই বাড়ির তিন নম্বর বাথরুম। রান্নাঘরের পেছন দিক দিয়ে যেতে হয়। আমাদের বাড়িটা দাদার আমলে বানানো পুরনো বাড়ি। এক তলা আর দোতলা আমরা ব্যবহার করি, তিনতলায় ছাদে দুইটা রুম ভাড়া দেওয়া। মেজো ভাইয়া অনেক দিন ধরেই বাড়িটা ডেভেলপারকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে, বড় ভাইয়া সম্ভবত প্রস্তাবটা গা করছে না, কিংবা বাবাই হয়তো রাজি না। আমি অতশত জানিনা, আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কী? যতদূর অনুমান করতে পারি আমার তিন ভাইয়ের কেউই এই বাড়ির পেছনে কোন রকম ইনভেস্ট করতে রাজি না, সেইজন্যে নোনা পড়া দেওয়ালে রঙ করা হয় না, ডাইনিং রুমের বেসিন ভেঙে পড়ে আছে কিন্তু নতুন বেসিন কেউ লাগাচ্ছে না, খাওয়া শেষে রান্নাঘরের সিংকে হাত ধুয়ে আসে সবাই।

আমার ছোটভাই থাকে ইউকেতে, সেখানে জীবন অনেক কঠিন, মাঝেমধ্যে বাবার চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা পাঠায় এবং সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় যে সে বিদেশে মহা কষ্টে আছে। আমি জানিনা বিদেশ গিয়ে যদি কারো মহা সংগ্রামের মধ্যেই থাকতে হয় তাহলে সে দেশে ফিরে আসে না কেন।
গত তিন মাসে কেউ এই বাথরুম ব্যবহার করেনি, এর দরজাটা ভাঙা। অবশ্য ভাইদের ঠেলাঠেলির জন্য যে দরজা ভাঙা পড়ে আছে তা না। আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে ফাতেমা এই বাথরুম ব্যবহার করতো, তিন মাস আগে সে এই বাথরুমে সুইসাইড করেছে, তাকে দরজা ভেঙে বের করা হয়েছিল- সেই থেকে দরজাটা ভাঙা। আমাদের কাজের মেয়ে বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। ফাতেমা আসলে ছিল মেজো ভাবীর কাজের মেয়ে। পত্রপত্রিকায়ও খবরটা সেভাবেই এসেছিল। অবশ্য আমাদের বাসার আর সবাই সাধারণ মানুষ, দেশের লোক আমাদের চেনে না, চিনলে ভাবীকেই চিনবে। তাই ফাতেমার বেতন যদি আমরাও দিতাম, আত্মহত্যার খবরে ভাবীর নাম আসারই কথা।
আমার মেজো ভাবী একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, নাম বললে আপনারাও চিনবেন, তাই বলছি না। এমনিতে খুব অমায়িক আর সুশীল হলেও ফাতেমার সঙ্গে সে খুব বিশ্রী ব্যবহার করত। আমাদের বাড়ির কারো কোন কাজ করতে গিয়ে তার ফরমাশ করতে দেরি হলেই অকথ্য গালিগালাজ করতো। আমাদের সামনে করতো না, দোতলায় গেলে পরে করতো। আমি একদিন শুনেওছিলাম। কাপড় মেলতে ছাদে যাচ্ছি, শুনলাম ভাবী ফাতেমাকে বলছে, “বেতন আমি দেই, আর কাজ করস অন্য মানুষের? ভাত খায় ভাতারের, লাঙ্গের পায়ে দেয় তেল?” ভাবী যে ‘লাং’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে পারে তাই আমার জানা ছিল না। ছায়ানটে গান শেখা একটা মেয়েও যে গৃহকর্মিনীকে এমন নোংরা কথা বলতে পারে তা হয়তো অনেকে বিশ্বাসই করবে না। সেদিন মাকে বলেছিলাম ওকে দিয়ে কোন কাজ না করাতে। মা আবার এতে বেশ ক্ষেপে গেছিলেন, বেতনটা ভাবী দিলেও ফাতেমার খাওয়া দাওয়া আমাদের একান্নবর্তী সংসারেই হতো, সে হিসেবে তাকে দিয়ে কাজ করানোর অধিকার আমাদেরও নিশ্চয়ই আছে। আমার আর বীথির পুরনো জামাকাপড় ফাতেমাকে দেওয়া হতো, সে সেগুলো সেলাই টেলাই করে পরতো। মায়ের কথায় যুক্তিও আছে, তাই আমি মায়ের সঙ্গে তর্ক করিনি, কিন্তু বেচারা ফাতেমার জন্য খারাপ লেগেছে। তাকে দিয়ে আমি কোন কাজ করাতাম না। অবশ্য বাসায় আমার স্ট্যাটাস ফাতেমার চেয়ে কোন অংশেই বেশি না।ফাতেমা কাজ করতো টাকার বিনিময়ে, আমি এবাড়ির কাজগুলো করি বিনা পয়সায়। বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল দেওয়া, বিছানার চাদর পর্দা জাতীয় জিনিসপত্র লন্ড্রি থেকে আনা নেওয়া, ফ্রিজ নষ্ট হলে মিস্ত্রি ডেকে আনা- এসব আমাকেই করতে হতো। এখনো করতে হয়।

উম্মে ফারহানার গল্প
বাসায় আমি যেহেতু কোন টাকাপয়সা দেই না, তাই এই কাজগুলো করা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এই বাড়ির সবাই এমনই মনে করে। একদিন আমার ছোটবোন বীথির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ব্যাপারটা আমি টের পেয়েছিলাম। বীথি এখানে থাকে না, সে থাকে তার শ্বশুরবাড়িতে। তার শ্বশুরবাড়িতে এটা সেটা পাঠাতে হলেও আমাকেই নিয়ে যেতে হয়। বড় ভাইয়া কিংবা মেজো ভাইয়া কোনদিন যায় না, তারা ব্যস্ত মানুষ। গত রমজানে ইফতার নিয়ে গিয়ে খুব ক্ষোভের সঙ্গে একথাটা বললাম, দেখলাম সে আমার উপরেই বিরক্ত হলো। ‘বাড়িতে থাকলে সেখানে কিছু কন্ট্রিবিউট তো করতেই হয়’- এমন একটা মন্তব্য করলো। আমার ইচ্ছা করছিল বলি ‘তুই যখন বাড়িতে ‘থাকতি’ তখন কোন ঘোড়ার ডিমের কন্ট্রিবিউট করতি?’ কিন্তু বলিনি ঝগড়া লাগার ভয়ে। এমনিতেই আমার বোন দেখতে সুন্দরী বলে সবার ধারণা আমি তাকে হিংসা করি। আমার বিয়ে হয়নি কিন্তু তার ভাল বিয়ে হয়ে গেছে- এটাতে নিশ্চয়ই আমি আরো বেশি ঈর্ষান্বিত, ইফতার নিয়ে না যেতে চাইলে সবাই এমনই ভাববে। সেই ভয়ে রোজার দিনে ইফতার, কোরবানির সময় গোশ্ত নিয়ে আমি যেতাম। বীথি শুধু দেখতেই ফর্সা এমন না, সে লেখাপড়ায়ও বেশ ভাল। কৃষি কলেজ থেকে ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করেছে, বিসিএস দেবে বলে লেখাপড়া করছে। সেইজন্য তাকে হিংসা করতে হবে এমন না। নিজের অযোগ্যতা নিয়ে আমার কিছু হতাশা অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা তার যোগ্যতার সঙ্গে তুলনা করার কিছু নেই। অন্তত আমি এরকমই মনে করি। কিন্তু ফাতেমা আত্মহত্যা করার পর বাড়িতে হুড়মুড় করে আসা আত্মীয়দের কথাবার্তায় দেখলাম তারা অনেকেই খবর শুনে ভেবেছিল আমিই আত্মহত্যা করেছি। দেখতে খারাপ, রঙ কালো, বিয়ে হয়নি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে কোন চাকরি বাকরি পাচ্ছে না- এমন মেয়ের সুইসাইড করার হাজারটা কারণ থাকতে পারে, কাজের মেয়ে সুইসাইড করবে কোন দুঃখে?
দরজা ভাঙা বাথরুমে ঢুকে আমি দেখলাম বাথরুম শুকিয়ে খটখট করছে। এমনিতে আমাদের বাড়ির পুরনো আমলের লাল সিমেন্টের মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকে, এমন শুকনো থাকে না। ফাতেমাকে বের করার পর সুইপার ডেকে বাথরুম পরিষ্কার করা হয়েছিল, পুলিশ এসে দেখে যাবার পরে অবশ্য। ডেডবডি মর্গ থেকে ছাড়াতে বেগ পেতে হয়েছিল, টাকা পয়সা খাওয়াতে হয়েছে। পুলিশদেরকেও মেলা টাকা দিতে হয়েছে, আত্মহত্যা প্রমাণ করার জন্য পুলিশের বয়ান জরুরি। যেহেতু মেজোভাবী সেলিব্রিটি মানুষ, তাই তার কিছু হেটার্স আছে, তারা ফেইসবুকে ছিছিক্কার ফেলে দিয়েছিল এই বলে যে বিখ্যাত লোকজন কীভাবে কাজের মেয়েদের মেরে ফেলে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চায়, টাকা দিয়ে নিষ্পত্তি করে মামলা। গত তিনমাসে মেজো ভাবীর গানের অনুষ্ঠানে ডাক পড়াও কমে গেছে মনে হয়। সে অবশ্য তিনমাসে আমাদের এই বাড়িতে থাকেনি বেশি। মায়ের বাড়িতে চলে গেছিল। আমার ধারণা মেজো ভাইয়া আর ভাবী এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুধুই বাড়ির উপরে অধিকার বজায় রাখার জন্য। ডেভেলপারকে বাড়ি দিয়ে দেবার জন্য মা বাবাকে রাজি করাতে হলে দূরে গিয়ে থাকা চলে না।
কল ছেড়ে দেখলাম পানি আসছে। কিন্তু বদনাটা ব্যবহার করলাম না ইচ্ছা করেই। টিস্যু পেপার ভিজিয়ে মুছে ফেললাম। ইউরিন ইনফেকশনের পর থেকে এসব ব্যাপারে আমি সাবধান হয়ে গেছি, যে কোন জায়গায় বাথরুমের বদনা ব্যবহার করিনা। খুব দ্রুত প্রস্রাব করে উঠে দাঁড়ালাম, ভাঙা দরজার পাল্লাটা পাশের দেওয়ালে হেলান দেওয়া ছিল, সেটা টেনে দরজায় ঠেকা দেওয়া আমার সাধ্যে কুলাতো না। তাই মোটামুটি খোলা একটা জায়গায় হিসু করার অনুভূতি হলো। এই প্যাসেজের শেষ মাথার প্রায় পরিত্যক্ত বাথরুমে কেউ আসবে না জানি, তবু প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করলাম। পায়জামার ডুরি বেঁধে বাথরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভেন্টিলেটরের রডে কাপড় ঝোলানো।মনে হয় বাইরে থেকে দেখা যাওয়ার ভয়ে। আমাদের বাড়িটা আগে বেশ উঁচুই ছিল। কিন্তু পেছনের রাস্তা গত দশ পনের বছরে অনেকবার উঁচু হয়েছে। রাস্তা থেকে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত নাগাল পাওয়ার কথা না, কিন্তু এখন রাস্তা থেকে একটু চেষ্টা করলেই পাঁচিলে উঠে যাওয়া যাবে। মান্ধাতার আমলের ভাঙা কাচ লাগানো দেওয়ালের উপরে ছালা ফেলে ওঠা কোন ব্যপারই না এখন আর।
ফাতেমাকে অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পরেও যখন সে দরজা খুলছিল না, সরাসরি দরজা ভাঙার প্রস্তাব দিয়েছিল মেজো ভাবী। মাও সায় দিয়েছিল তাতে। রাস্তার দিক থেকে ভেন্টিলেটরে উঁকি দিয়ে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষন করার কোন দরকার নেই। আমরা তখনও জানতাম না যে লোকজন এড়ানোর কোন উপায়ই আসলে নেই। গত তিনমাস ধরে আমরা পাড়ার সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছি। মামলা ডিসমিস হলো কিনা, ফাতেমার মাবাপকে কত টাকা দেওয়া লাগলো, আসলেই কি ফাতেমা প্রেগন্যান্ট ছিল কি না- এমন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে আমাদের চারদিকে। কখনো ফিসফাসে, কখনো আকারে ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি প্রশ্নগুলো তেড়ে আসে আমাদের দিকে।
আমি এতোদিন এইসকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অবকাশ পাইনি। মেজো ভাবীর সঙ্গে মেজো ভাইয়ার প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছে একদিন, তার পর থেকে ভাবী আর বাড়িতেই নেই। ফাতেমার মা বাবা আমাদের বাড়িতে আসেওনি, ভাবীর মায়ের বাড়িতে এসেছে বলে শুনেছি। পাঁচ লাখ টাকা তাঁদের দেওয়া হয়েছে এমন তথ্য নাকি পত্রিকায় পড়েছে মা। তারা হত্যা মামলা দিয়ে দিলে আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো ভাবীর কেরিয়ারের।
আমি পত্রিকা টত্রিকা পড়ি না। খবরগুলো জেনেছি আসাদের কাছ থেকে। আসাদ আমার ক্লাসমেট, সবাই ভাবে যে আমি হয়তো আসাদের সঙ্গে প্রেম করি, কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো আসাদের প্রেম তার এক খালাতো বোনের সঙ্গে। বেকার ছেলের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয় না, কাজেই আসাদের সেই খালাতো বোনের বিয়ে হয়ে গেছিল এক ব্যাংকারের সঙ্গে, কিন্তু তাদের প্রেম এখনো টিকে আছে। আসাদ আমাকে কিছু খবর দিলো একদিন। আমি ভাবলাম এমনিই কৌতূহলের জন্য জানতে চাচ্ছে। পরে দেখি ব্যাপারটা তা না, সে আরো কিছু তথ্য বের করতে চায়। তার কোন এক বন্ধু একটা লোকাল নিউজপেপারের রিপোর্টার, সে-ই মনে হয় অনুরোধ করেছে আমার কাছ থেকে খবর বের করে দিতে।
“সাথী আপা, এই সাথী আপা”- আমি ফাতেমার গলা শুনতে পেলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এটা অডিটরি হ্যালুসিনেশন। তিন মাস আগে ফাতেমা মারা গেছে, তার অতৃপ্ত আত্মা এখনো বাথরুমে আটকে আছে আর কেউ আশেপাশে থাকলে তার নাম ধরে ডাকছে এমন হতেই পারে না। আমি তবু পেছন ফিরে তাকালাম। খুব নিশ্চিত ছিলাম কাউকে দেখতে পাবো না, কিন্তু দেখলাম ফাতেমা দাঁড়িয়ে আছে, পরনে একটা কালো কামিজ আর সবুজ ওড়না। আমি বললাম, কি রে ফাতেমা, কী খবর?” ফাতেমা হাসলো। তারপর বললো, “আপা, আপনার বন্ধুরে বইলেন যে আমি নিজের ইচ্ছায়ই মরছি”। আমি বুঝতে পারলাম, যা শুনতে চাই, তাই শোনাচ্ছে আমাকে আমার কল্পনার ফাতেমা, কিংবা ফাতেমার ভূত। আমি বললাম, “তুই এই কাজটা কি ঠিক করলি? আমরা যে কী বিপদে পড়লাম তোর জন্য”। ফাতেমা মাথা নিচু করে বলল,”বিপদে ফালানোর জন্যেই করছি, আপনেরারে না, মেজো ভাবীরে”। মেজো ভাবীর ব্যাপারে ফাতেমার রাগ বিদ্বেষ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই রাগে সে আত্মহত্যা করবে কেন? কাজ ছেড়ে দিলেই পারতো। আমি সে কথা জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম ফাতেমার ভূত নেই সেখানে।
রাতে ঘুমটুম ভালো না হলে মানুষ অনেক কিছু উদ্ভট কল্পনা করে নেয়। এই পড়ন্ত বিকেলে, বাইরে যখন রোদ মরে এসেছে, পুরনো বাড়ির আনাচে কানাচে ছায়া জমছে, পরিত্যাক্ত বাথরুমের ভাঙা দরজার সামনে ভূত দেখার মতন অভিজ্ঞতা হওয়া খুব অস্বাভাবিক কিছু না। আমি এইসব প্রেতাত্মা জাতীয় জিনিসে একেবারেই বিশ্বাস করি না।
বাথরুমের সামনের প্যাসেজ দিয়ে বাইরে বের হয়ে দেখলাম প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে। ঘরে ব্যাগ রেখে আমি ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোলাম। দোতলায় মেজো ভাবীদের দরজায় তালা ঝুলছে। আমি সেই দরজার সামনে থামলাম না। এই দরজার পেছনে এমন কিছু ঘটেছিল যে জন্য ফাতেমা মরে গেছে। আমি বিশ্বাস করতেই চাই না যে আমার ভাই ফাতেমাকে রেইপ করতে পারে এবং সেজন্য সে প্রেগন্যান্ট হয়ে সুইসাইড করতে পারে। কিন্তু ভাবীর ঝগড়া করে চলে যাওয়া এবং আর না আসা দেখে কিছুটা সন্দেহ তো হয়ই। আমি ছাদে উঠতে উঠতে মাগরিবের আজান শুনতে পাই। মা সবসময় বলেন ভর সন্ধ্যায় আকাশের নীচে থাকতে নেই, ঘরে থাকতে হয়। আমি আজান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই ছাদের ঘর থেকে খোলা আকাশের নীচে চলে যাই।

উম্মে ফারহানার গল্পছাদের দরজা চেপে দিয়ে ছাদের মেঝেতে শুয়ে পড়ি,ছাদের ঘরে যে মেয়েদুইটা ভাড়া থাকে তারা ছুটিতে বাড়ি গেছে, তাই ছাদ খালি। আমি একা শুয়ে আকাশ দেখতে থাকি। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখলে আকাশটাকে বড় মনে হয়।আকাশের দিকে তাকিয়ে ফাতেমার কথাই ভাবতে থাকি। ফাতেমার মৃত্যুর পরে আমাদের বাসায় কোন মিলাদ পড়ানো হয়নি। কোন কোরানখানি কিংবা দোয়া খায়ের করাও হয়নি। বাসার কাজের মেয়ে স্বাভাবিক ভাবে মরলেও এসব হয় না, আর এ হলো অপমৃত্যু। মামলা সামলাতেই এখনো জেরবার মেজো ভাই আর ভাবী। তবুও একটু হুজুর ডেকে দোয়া করানো উচিৎ ছিল মনে হয়। মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে মা নামাজ পড়ে ফাতেমার জন্য দোয়া করেছিল কিনা। কে জানে, জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হতে পারে। পুরো ব্যাপারটাতে সবচেয়ে প্যানিকড হয়ে ছিল মা। এখনো তার সেই টেনশন যায়নি। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমায়, পাশের বাসার তনুর মায়ের সঙ্গে গল্প করতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এসব গসিপ শুনতে হয় বলে।
আমি ঠিক করলাম, মাকে জিজ্ঞেস করার চেয়ে আমি নিজেই বরং একটু দোয়া করে ফেলতে পারি। মহামারিতে মরলে, বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মরলে মানুষ নাকি বেহেশতে ঢোকার সময় শহীদের দরজা পায়। আর সুইসাইড করলে অনন্ত নরকবাস। কিন্তু যাদের জন্য জীবন অসহনীয় হয়ে যায়, তারা স্বেচ্ছায় জীবন ছেড়ে দিতে চাইলে কেন শাস্তি পেতে হবে, কেন তাদের জানাজা হবে না, তাদের জন্য দোয়া হবেনা? তাদের জীবন যে মহামারীর চেয়েও কঠিন হয়ে গিয়েছিল, সেটা কি তাদের দোষ? শহীদের দরজা কেন তারা পাবে না?

শোয়া থেকে উঠে গিয়ে আমি প্রথমে ছাদের দরজা আটকালাম, তারপর ট্যাংকে লাগানো কলের পানিতে ওজু করে নিলাম। হিসু করার পর পানির বদলে টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে শরীর পাক হয় কিনা জানি না, হতেও পারে, আরব দেশে তো পানির অভাব ছিল, তায়াম্মুম বলে একটা জিনিস আছে মায়ের কাছে শুনেছি। ওজু করে নিয়ে আমি পশ্চিম দিকে ফিরে বসি, মাথায় ওড়না দিয়ে দোয়া শুরু করতে গিয়ে দেখি পশ্চিমের আকাশটা নীল কমলা আকাশী আর সোনালি মিলে নেশা ধরানো একটা দৃশ্য তৈরি করেছে, আমার মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বাদুর উড়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে পড়তে শুরু করি, “আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইউল কাইউম”

Advertisement
Share.

Leave A Reply