fbpx

ঊনপঞ্চাশ বাতাস—মাথা নয়, মনের ভেতর যাই

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। ৮ সপ্তাহ ধরে সিনেমা হলে ছবিটি চলছে। ছবিটি ‌দেখার প্রতিক্রিয়া বিবিএসবাংলার জন্য লিখেছেন লেখক ও সাংবাদিক তায়েব মিল্লাত হোসেন।

বড়ঘরের মেয়ে নীরা। ছোটঘরের ছেলে অয়ন। তাকে ভালোবেসে ফেলে নীরা। অয়নকে নিয়ে জনারণ্যেই যেন নিভৃত মেলে তার। যেনবা পরাবাস্তবের জগতে বসতি। এভাবে এভাবে দুজনার তুমুল প্রেম। এমনি এক সময়ে ঘাতকব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে অয়নের। তার আয়ু আর বড় জোর ছয় মাস। এ অবস্থায়ই অয়নকে বিয়ে করে নীরা। অল্প কয়েকদিনের সংসার। তারপর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় অয়নের।

এবার কী হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের মতো আত্মহননের পথে যাবে নীরা? না, এখানে এসেই মাসুদ হাসান উজ্জ্বল নিজের আলো ছড়াতে পেরেছেন। যা ছিলো আপাত-প্রণয়ের একটি কাহিনী তা নিয়ে গেছেন ভূতের ভুবনে। হাজির করেছেন কল্পবিজ্ঞান। এনেছেন মেডিকেল ফিকশন বা চিকিৎসা-উপাখ্যান। আর চূড়ান্ত মোচড় সাইকো থ্রিলার বা মনোজাতিক রোমাঞ্চ। এই মনের খবর বাইরে থেকে আঁচ করা যায় না। কেননা এর প্রতিফলন থাকে কেবল মাথার গণ্ডগোলে। তাই আমরা আসলে মনের বিষয় বুঝতে পারি মাথা ও তার বিগড়ানোর আয়নায়। তাই তো ছায়াছবির নামখানি- ঊনপঞ্চাশ বাতাস।

পাগলামি বা উন্মাদনা অর্থে মাথা গরম হওয়ার কথা জানতাম। জানতাম বায়ুচড়ার কথা। বায়ুগ্রস্ততা, বায়ুরোগও অনেক চেনা। এমনকি ‘মাথা ফরটি নাইন’ বহুল প্রচল কথা। কিন্তু আমার জানাই ছিলো না ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ বিষয়ে। যা আদতে ‘ঊনপঞ্চাশ বায়ু’। তাই চলচ্চিত্রের নামখানি ভাবনায় ফেলে দিয়েছিলো। দ্বারস্থ হতে হয় অভিধানের। করতে হয় গুগল।

সহজেই সমাধান করে দেন শব্দ-গবেষক ড. মোহাম্মদ আমীন। তার গবেষণামতে, বাংলা বাগধারা হিসেবে প্রচলিত ‘ঊনপঞ্চাশ বায়ু’ শব্দদ্বয়ের আভিধানিক অর্থ পাগলামি বা উন্মাদনা। ঊনপঞ্চাশ বায়ুর উৎস হিন্দু পুরাণ। ঋগ্বেদ সংহিতায় রয়েছে, মরুৎগণ ঝঞ্ঝার দেবতাদের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী। তারা সংখ্যায় ঊনপঞ্চাশ জন, ঊনপঞ্চাশৎ মরুৎ। বায়ুর সমার্থক এই মরুৎ। ঊনপঞ্চাশ জন ঝঞ্ঝার দেবতা একসাথে কোনো কাজ করলে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো। তাই মাথায় ঊনপঞ্চাশ বায়ু চড়েছে বলতে পাগলামির বিষয়টিকে বুঝানো হয়ে থাকে। এই হলো ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নামকরণের ইতিবৃত্ত।

তবে নীরা সবশেষে পাগল হয়ে যায়- এভাবে বইয়ের কাহিনীর রায় দেয়া যাবে না। অয়নের স্মৃতি অবলম্বন করে বেঁচে থাকে সে। রোজই যায় কবরস্থানে। যায় অয়নের চোখ ও হৃৎপিণ্ড দানে যাদের জীবনে নতুন দুনিয়া হাজির হয়েছে তাদের দেখতে। তারপরও কেবল শোকের সাগরেই থাকেনি নীরা। প্রাণিবিদ্যার পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছে। ডিএনএ ও জিনতত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা করেছে। তার স্বপ্ন এভাবে অয়নকে ফের পৃথিবীতে আনবে নীরা। গবেষণা হিসেবেই অয়নের কবরে তরল ছিটিয়ে আসে। তারপর একরাতে কাফনের কাপড় ও মাটিমাখা দেহ নিয়ে নীরার বাসায় হাজির হয় অয়ন। তাকে গোসল করিয়ে পরিপাটি রূপ দেয়। সেই রাতে বাসায় আসে নীরার ভাই। শিহরিত দর্শক তখন গল্পে পায় আসল মোচড়। নীরা দেখে অয়নকে। আসলে কোথাও কেউ নেই! সবই তার হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম। বাস্তবতা কেবল একটি কক্ষে অয়নের ডিএনএ গবেষণার সমস্ত কাগজ চারদেয়াল জুড়ে লাগানো আছে। ভাইকে সেই কাগজ দেখিয়ে যেনবা অয়নকেই দেখায় নীরা। দিস্তা দিস্তা নোটের ভিড়ে আমাদের মনে পড়তে পারে ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ সিনেমার গণিতবিদের কোনো কক্ষের কথা। সেই ভাবনা নিয়েছেন কিনা জানি না, তবে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নির্মাণ সবটা মিলে মৌলিকত্বেই রূপ পেয়েছে। সব মূলের পেছনে অন্য কোনো শিকড়ের বীজ বা তারই ধারাক্রম থেকে যায়।

এতোক্ষণ থাকা হলো গল্পে ও নামে। ক্যামেরায় কেমন, সম্পাদনার মানে কতটা এগিয়েছে আমাদের ঢাকাই সিনেমা, কলকাতার সঙ্গে টক্কর দিতে পারবে তো?

প্রথমত ক্যামেরায় আসি। সদরঘাটের পন্টুন, পুরান ঢাকার পথকুকুর, বাংলাবাজারের বই, মিটফোর্ডের সুগন্ধির রাসায়নিক- বায়ান্নো বাজার তেপ্পান্নো গলির শহরকে নিয়ে মনযোগ ছিলো সিনেমাটোগ্রাফিতে। ছিলো নয়া জমানার ড্রোন ক্যামেরার কেরদানি। এসবই আলগা নয়, গল্পের ভেতর দিয়েই এসেছে। আর সেখানেই এসে সম্পাদনার গুণমানের প্রসঙ্গ। দৃশ্যের পর দৃশ্য জোড়া লাগিয়ে লিখে রাখা গল্পকে চেহারায় নিয়ে এসেছেন সম্পাদক। রোমাঞ্চ, ভূত, বিজ্ঞান, বিরহ- এতোসব কিছু দিয়ে দর্শক বিমূগ্ধ রাখা গেছে তো নিপুণ সম্পাদনার কারণেই। গত দুই দশকে কলকাত্তাই চলচ্চিত্রে যে দিন বদল, তার অনেকখানি পথ ধরে ফেলতে নিশ্চিত করেই সক্ষম ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। গল্প-ক্যামেরা-সম্পাদনা-গান-সংলাপ সবটা মিলেই হেঁটে হেঁটে হলে গিয়ে দেখার মতো সিনেমা। আবার নেটে নেটফ্লিক্সের মতো ওটিটির পাটাতনের কাহিনীচিত্র হিসেবেও দারুণ যাবে।

তো নট-নটিরা কেমন করেছেন- এখানে। প্রধান দুই চরিত্রই আমার অচেনা, আমার চোখে নতুন মুখ। তাই তারা নয়, চরিত্রই ঢুকে পড়েছে আমার ভেতরে। যার সার্থকতা তো অভিনয়শিল্পীদেরই। তাই নীরা (শার্লিন ফারজানা) ও অয়ন (ইমতিয়াজ বর্ষণ) ধন্যবাদ পাওয়ার আবশ্যক দাবিদার। আরও ধন্যবাদ দিতে হয় দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীর রূপদানকারী বালকটিকে। চোখের আলো নেই, তবু চিড়িয়াখানা দেখতে ঢাকায় আসার মর্মস্পর্শী গল্প আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবে আলাদা করেই।

মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নবতর সৃজন নিয়ে কেবলি আমার শংসাবচন। সংশয়ের জায়গা আসলে নেই? আছে বটে। নির্মাণকাল ছিলো স্বাভাবিক দুনিয়ায়। দর্শকের দুয়ারে এসেছে নয়াবাদি শহরের দিনে। তাই জনতার এতো এতো মুখের ভিড়ে মুখোশের আকাল একালে অস্বাভাবিক লাগবে। স্বাভাবিকতা হারিয়েছে করমর্দনও। নতুন স্বাভাবিক দুনিয়ায় এর নির্মাণ হলে দৃশ্যপটতো বটেই মনস্তাত্ত্বিক জায়গায়ও নিশ্চিত অনেক বদল বয়ে যেতো। পরম করোনাময় দুনিয়ার ঘাত শুধু দেহে নয়, লেগেছে মনেও। আর ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ তো আমাদের বাস্তব শহরের পরাবাস্তবতার কাহিনিই শেষ অবধি- যেখানে মাথার চেয়ে বেশি দামি আদতে মনোজগত।

ঊনপঞ্চাশ বাতাস
চিত্রনাট্য, সংলাপ, সংগীত ও পরিচালনা: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল
দৈর্ঘ্য : ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট
অভিনয়ে : শার্লিন ফারজানা, ইমতিয়াজ বর্ষণ, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলোরা গহর, ড. ইনামুল হক প্রমুখ।
নির্বাহী প্রযোজক: সৈয়দা শাওন
ব্যানার: রেড অক্টোবর

Advertisement
Share.

Leave A Reply