‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়-এই কথার মধ্য দিয়েই বোঝা যায় বর্ষা ঋতু কতটা প্রিয় ছিল হুমায়ুন আহমেদের। আর ঠিক এমন এক বরষায় না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ওপারে বসেও কি তিনি এই বর্ষায় নিজের কাছে ডাকছেন তাঁর প্রিয়জনকে।
তাঁর হলুদ পাঞ্জাবীর ভবঘুরে দার্শনিক হিমু কিংবা অদ্ভূত গোয়েন্দা মিসির আলীর চরিত্রগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় বাংলা সাহিত্যের পাঠককে। বলা হয়ে থাকে, এক সময় অনেক তরুণ হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হিমু হয়ার চেষ্টায় রাস্তায় ঘুরতেন রাত-বিরাত। কেউবা মিসির আলীর মত গোয়েন্দা হতে চাইতেন।
তাঁর লেখা জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের চোখে। কিছু নারী-পুরুষ হিমুকে সত্যি বলে মনে করেন। আবার কোন কোন হিমুভক্ত পাঠক নিজেকে হিমু বলে দাবি করেন এবং হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ান রাতের শহরে। হিমু একেবারে আলাদা ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। সে প্রায়ই নিয়মের বাইরে গিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়, কখনও বা ভিন্ন রকমের আচরণের কারণে বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। তার আচরণ অনেক মানুষকে তাকে মহাপুরুষ ভাবতে প্রভাবিত করে। হিমুর এই সৃষ্ট চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদকে বাঁচিয়ে রাখেন পাঠকের অন্তরে অন্তরে।
বলা হয়ে থাকে বিশ শতকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও পাঠকের পছন্দের শীর্ষবিন্দুতে ছিলেন তিনি। লেখক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো বিশাল পাঠকসমাজ তৈরি এবং তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলা।
তিনি শুধু লেখকই ছিলেন না, ছিলেন গুণী নির্মাতাও। এসব কাজকে ভালবেসে ছেড়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানে চাকরী করার মোহ।
জনপ্রিয় লেখক পরিচয়ের বাইরে তিনি নিজেকে গুণী এবং সফল নির্মাতা হিসেবে প্রমাণ করেন। তাঁর সিনেমা জগত খুবই রঙিন। সিনেমা ইন্ডাস্টিতে হুমায়ুনের পথচলা শুরু লেখালেখি দিয়েই। তাঁর লেখা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান।সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
সুস্থ ধারার সিনেমা বলতে যা বোঝয় সেটাই উপহার দিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। তিনি মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলমুখী করে তোলেন। শুধু সিনেমা নির্মানেই যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা নয়, তাঁর নির্মিত নাটক এখনও দর্শকনন্দিত। বেঁচে থাকতে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।
গানের জগতেও ছিল তাঁর সমান অবদান। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চাল’, ‘আইজ আমার কুসুম রাণীর বিবাহ হইবো’র মত গানের জন্ম হয় তাঁর হাত ধরে।
হুমায়ূন আহমেদের সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন। অবসরে আঁকতেন ছবি। জীবনের প্রায় শেষ একযুগ তিনি কাটিয়েছেন গাজীপুরের বাগানবাড়ি নুহাশপল্লীতে। সেখানে থাকতেই তিনি ভালোবাসতেন। গল্প রসিকতার মিশেলে তিনি ছিলেন আড্ডাবাজ একজন মানুষ।
সিগারেট পাগল মানুষটির কাছে মনে হত, সিগারেট খাওয়ার কাছে মৃত্যুভয় তুচ্ছ। কোনোভাবেই এই সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইতেন না তিনি।
আজ ১৯ জুলাই, ২০১২ সালে থেমে যায় হিমু-রূপা কিংবা মিশির আলির উপাখ্যান। বাংলা সাহিত্যে যার হাত ধরে নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল সেই কোটি মানুষের লেখক হুমায়ুন আহমেদ চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান।