fbpx

কানাডায় কাজ কাজই; নেই ছোট, বড় বিভেদ

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

একেক দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী একেক রকম। আবার চিন্তা-ভাবনার ধরণও ভিন্ন। কানাডার জীবনের প্রথমদিকে অনেক কিছুই তাই বুঝে উঠতে পারতাম না।

অনেকদিন আগের কথা। একবার আমার অফিসের এক ভাইস প্রেসিডেন্ট, নাম ক্যাথরিন, লাঞ্চরুমে বসে খুব উচ্ছসিত সে। তার মেয়ের চাকরি পাওয়ার গল্প করছিল। আমি মাইক্রোওয়েভে আমার লাঞ্চ গরম করতে করতে ভাবছি, ওর মেয়ে এই বয়সে কোথায় জব পেল, মোটে তো গ্রেড টুয়েলভে পড়ে।

কানাডায় কাজ কাজই; নেই ছোট, বড় বিভেদ

এসব দেশে কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করে না কে কোথায় চাকরি করছে? নিজে থেকে কেউ বললে ঠিক আছে, কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাটা অভদ্রতা। প্রতীকী ছবি

ক্যাথরিন এই অফিসে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাকরি করছে সাত বছরের মতো। এর আগেও সে আরেকটা প্রতিষ্ঠানে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিল। তার বার্ষিক বেতন সাড়ে তিন লক্ষ ডলারের মতো। এদেশে যারা বছরে এক লক্ষ ডলারের বেশি বেতন পায় তাদের নাম সান সাইন লিস্টে প্রকাশ করা হয়। সেভাবেই জানি ওর বেতন কত।

ক্যাথরিনের স্বামীও একটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে কর্মরত। তার বেতন ক্যাথরিনের চেয়েও বেশি। ওরা দুজন মিলে বছরে সাড়ে সাত লক্ষ ডলারের মতো আয় করে। ওর বাসা বে ভিউতে, যেখানে ধনী লোকজন থাকেন।

একবার আমাদের অফিসের একটা পার্টি ওর বাসায় হোস্ট হয়। দেখার মতো বাড়ি। গেট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর যাওয়ার পর পার্কিং লট। দশ-বারটা গাড়ি অনায়াসে পার্ক করা যায় সেখানে। এমন আলিশান বাড়ি আমি আমার জীবনেও দেখিনি। ঘরের ভেতরে সবকিছু অসম্ভব সুন্দর, রুচিশীল এবং পরিপাটি। গেট দিয়ে ঢোকার পথটার দুধারে সুদৃশ্য বাগান, মাঝখানে একটা ফোয়ারা দিয়ে পানি ঝরছে। বেক ইয়ার্ডে একটা সুইমিং পুল, পাশে বেশ বড় জায়গা নিয়ে বসার ব্যবস্থা। অনায়াসে একশ লোকের পার্টি করা যাবে।

জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে এত বড় বাড়ি এবং বাগান সামলে রাখে? বলল, একটা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। ঘর পরিষ্কার করা, বাগান-সুইমিংপুল পরিচর্যা, ঘাস কাটা এবং শীতকালে স্নো পরিষ্কার করার জন্য ওরা নিয়মিত লোক পাঠায়। ওর এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, শুধু মাসে মাসে ভালো অঙ্কের একটা টাকা দিতে হয় ঐ কোম্পানিকে।

ক্যাথরিনের একটাই মেয়ে। মেয়েটা চাকরি পেয়েছে, তা নিয়ে সে মহাখুশি। আমি মাইক্রোওয়েভে খাওয়া গরম করে ওর পাশের সিটে যেয়ে বসে ওকে অভিনন্দন জানিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। আর খেতে খেতে ওর গল্প শুনছি।

বলল, সামারের যে দুই মাস স্কুল বন্ধ থাকবে, সে সময়ের জন্য মেয়ে চাকরি পেয়েছে। বেশ উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম, কোথায় চাকরি হয়েছে? উত্তর শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। যদিও আমার অবাক হওয়াটা চেপে রাখলাম, ওকে বুঝতেই দিলাম না। মেয়ের নোফ্রিল্সে চাকরি হয়েছে। নোফ্রিল্স একটা গ্রোসারী স্টোর। ওখানে ওর মেয়ে এন্ট্রি লেভেলে ক্যাশিয়ার পদে কাজ পেয়েছে। এই বয়সে এর চেয়ে ভালো চাকরি পাওয়ার কথাও না। কিন্তু আশ্চর্য এই ভেবে যে, যার এত টাকা-পয়সা তার মেয়ের চাকরি করার দরকারই বা কি? পায়ের ওপর পা রেখেই তো সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তাছাড়া এ চাকরিতে কয় টাকাই বা বেতন পাবে! ক্যাথরিনের এত খুশি হওয়ার কারণটাই আমি বুঝে উঠতে পারিনা। শেষে ও নিজেই বলতে শুরু করলো, মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, সাবলম্বী হবে, ঘরে ওর নিজের সব কাজ ও নিজেই করে, মাঝে মাঝে রান্না-বান্নাও করে, কিন্তু এই চাকরিটার কারণে বাইরের জগত সম্পর্কে ওর ধারণা হবে, পরিশ্রম করতে শিখবে, ওয়ার্ক এথিক্স সম্পর্কে জানবে, সর্বোপরি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে, তাই সে এত খুশি।

কানাডায় কাজ কাজই; নেই ছোট, বড় বিভেদ

এখানে যেকোনো কাজ করেই মানুষ সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারে। প্রতীকী ছবি

আরেক দিনের ঘটনা। আমাদের অফিসে ওয়ার্কশপ বা সেমিনারের আগে দিয়ে আইস ব্রেকিং সেশন হয়। সেশনটা শুরু হয় কোনো একটা মজার প্রশ্ন দিয়ে। সেদিনের প্রশ্ন ছিল, ‘তোমার জীবনের প্রথম চাকরি কি ছিল?’ সবার উত্তর দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। আমি ভাবলাম আগে অন্যদেরটা শুনি। পরে আমারটা বলবো। প্রতিষ্ঠানের যে প্রেসিডেন্ট কাম সিইও সে বলল, সে বেবি সিটার হিসেবে কাজ করতো। একটা বাসায় যেয়ে একটা বাচ্চাকে ওর বাবা-মা যতক্ষন অফিসে থাকত সে সময়টায় দেখাশোনা করতো। আইটির একজন ডিরেক্টর। বলল, সে পিজা ডেলিভারির কাজ করতো এবং এখানে চাকরি হওয়ার আগ পর্যন্ত সে ওটা করেছে। ভিপি ফাইনান্স বলল, সে ক্লিনার হিসেবে কাজ করতো। আরেকজন ডিরেক্টর বলল, সে টিমহর্টন্সে (কফি শপ) কাজ করতো।

আমার যে অফিসের কথা বলছি, সেখানে সবাই শাদা, আমি আর আরেকজন ব্রাউন এবং একজন কালো। ওদের প্রায় সবারই জন্ম এদেশে এবং ওরা এখানেই পড়াশোনা করেছে। সবাই ওদের জীবনের প্রথম যে জবের কথা বলল, কোনোটাই প্রফেশনাল জব না। আমরা বাঙালিরা একে বলি ‘অড জব’। ওদের অভিধানে ‘অড জব’ নামক কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কাজ ওদের কাছে কাজই। সব কাজই ওদের কাছে সম্মানের।

আমি চুপচাপ থাকলাম, আমারটা আর আমি কিছু বললাম না। ওদেরগুলো শুনে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল বলতে যে, আমার প্রথম চাকরি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। তাছাড়া এটাও ভেবে অস্বস্তি লাগছিল যে, ওরা সবাই স্কুলজীবন থেকে কাজ করা শুরু করেছে। আর আমি পড়াশোনা শেষ করে তারপর চাকরিতে ঢুকেছি। অবশ্য আমাদের দেশে তো আর ওদের মতো স্কুলে পড়ার সময় থেকে কাজ করার তেমন সুযোগ ছিল না। যদিও এখন সমাজ এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ছাত্রদের জন্য এখন অনেক কাজের ব্যবস্থা আছে শুনেছি- আড়ংয়ে অথবা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। কিন্তু আমাদের সময় সেটা ছিল না।

কানাডায় কাজ কাজই; নেই ছোট, বড় বিভেদ

কাজ হলো ওদের কাছে জীবিকার মাধ্যম, সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি নয়। প্রতীকী ছবি

একবার এখানকার এক পত্রিকায় এক নিওরোসার্জনের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার এত বছরের ক্যারিয়ার ত্যাগ করে ব্রেকিং প্রেফেশনে ঢুকেছে। তার নাকি চিকিৎসা পেশায় খুব স্ট্রেস হতো, তাই সে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। এখন সে কেক বানায় এবং সেটা তাকে অনেক মানসিক আনন্দ দেয়।

অনেকদিন আগের কথা, সে সময় আমি ইউনিভার্সিটি অব মেনিটোবাতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করতে এসেছিলাম। সেটাই আমার কানাডাতে প্রথম আসা। ছয় মাসের জন্য একাই এসেছি। যে ডিপার্টমেন্টে এবং যার সাথে কাজ করবো সেই ডিনকে বললাম, আমাকে একটা বাসা দেখে দিতে। ওর নাম সোফি। ও বলল, তুমি আগে আসো, তারপর বাসা দেখা যাবে। প্রথমে এসে আমার বাসায় উঠতে পার। আমার বাসায় অনেকগুলো রুম আছে। ছেলেরা বিয়ে করে নিজের মতো ওরা যার যার বাসায় থাকে। এ বাসায় শুধু আমরা বুড়া-বুড়ি থাকি। তুমি আমাদের বাসায় উঠলে আমাদের অনেক ভালো লাগবে।

এয়ারপোর্টে সোফি আমাকে রিসিভ করতে আসলো। তার আন্তরিকতা দেখে তো আমি মুগ্ধ। ওর বাসায় যেয়ে আরও অবাক হলাম। সেখানে একটা রুম খুব সুন্দর করে সে আমার জন্য গুছিয়ে রেখেছে। ওর স্বামীও ওর মতো যথেষ্ট আন্তরিক। খুবই ভাল একজন মানুষ। যদিও ঐদিনই ওদের সাথে আমার প্রথম দেখা। কিন্তু মনে হলো, সোফি এবং লিওকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি।

পরদিন থেকে আমার কাজ শুরু। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ওরা দুজন নাস্তা রেডি করে আমার জন্য বসে আছে। সেই সাথে আমার এবং ওর নিজের জন্য লাঞ্চ প্যাক করে রেখেছে। আমি তো খুবই অপ্রস্তুত বোধ করলাম। বললাম, তুমি কষ্ট করে কেন এগুলো করতে গেলে? ক্যাফেটারিয়াতেই তো আমি লাঞ্চ করে নিতে পারতাম! ও আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নাস্তা করতে বলল। তারপর রেডি হয়ে দুজন রওনা দিলাম। সোফি ড্রাইভ করছে আর ওর পাশে বসে গল্প করতে করতে এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম ইউনিভার্সিটিতে। কাজ শেষে আবার দুজন একসাথেই বাসায় ফিরলাম। লিও ওর কাজ থেকে আমাদের আগেই ফিরেছে। ঘরে এসে তো আমি অবাক। লিও আমার আর সোফির জন্য রাতের খাওয়া রেডি করে বসে আছে। খাওয়া শেষে আমরা সবাই মিলে সব গুছিয়ে ফেললাম। এভাবেই চলতে থাকলো কিছুদিন। আমাকে ওরা কিছুই করতে দেয় না। এমন কি বাসায় ফেরার পথে সোফি মাঝে মাঝে যখন বাজার করতে নামে আমি পে করতে চাইলে সে আমাকে পে করতে দেয় না। আমার বেশ অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। একদিন ওকে বললাম, আমি অনলাইনে কয়েকটা বাসার খোঁজ পেয়েছি, চল দেখে আসি বাসাগুলো।
ও বলল, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে?
বললাম, কি যে বলো? আমি তোমাদের কাছে অনেক বেশি ঋণী হয়ে যাচ্ছি।
ওর খুব মন খারাপ হয়ে গেছে দেখে বললাম, তোমার বাসাতেই না হয় আমাকে ভাড়া দাও। আর আমাকে বাজার করতে দিতে হবে।
ও বলল, প্রশ্নই উঠে না। তুমি আমাদের অতিথি।

কী যন্ত্রনায় পরা গেল! এতদিন ধরে কারো অতিথি হওয়া তো খুবই অস্বস্তিকর। আমি নিজেই বাসা দেখতে থাকলাম এবং ইউনিভর্সিটির কাছেই একটা বাসা পেয়ে গেলাম। সোফি এবং লিও যদিও বেশ মন খারাপ করল। তারপরও আমি জোর করেই উঠে গেলাম সেখানে। ওরা অবশ্য সাথে যেয়েই আমাকে ঐ বাসায় উঠিয়ে দিয়ে আসলো। আমাকে তারা তাদের নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতো। যদিও আমি আলাদা বাসায় থাকি, কিন্তু প্রতি শুক্রবারে কাজ শেষে সোফি আমাকে সাথে করে ওর বাসায় নিয়ে যেত। শনি, রবি দুই দিন ওদের সাথে থেকে সোমবার সকালে একসাথে আবার অফিসে চলে আসতাম। শনি, রবিবার আমরা তিনজন মিলে এখানে সেখানে ঘুরতে যেতাম। ছুটির দিনগুলো ওদের সাথে বেশ আনন্দেই কাটতো। লিও কোথায় চাকরি করে তখনও জানি না। একজন ডিনের স্বামী নিশ্চয়ই সেরকম চাকরিই করে। এসব দেশে কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করে না কে কোথায় চাকরি করছে? নিজে থেকে কেউ বললে ঠিক আছে, কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাটা অভদ্রতা।

একদিন ওদের সাথে গল্প করছি। তখন লিও নিজেই বলল, ওরা আরেকটা শহরে থাকতো। সেখানে ওর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ছিল। সোফির যখন এই ইউনিভার্সিটিতে চাকরি হয়, তখন রেস্টুরেন্টটা বিক্রি করে ওরা উইনিপেগ শহরে চলে আসে। রেস্টুরেন্ট চালাতে হলে অনেক সময় দিতে হয়, তাই ব্যবসা না করে লিও ওর এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে কাজ করে। বেশ অনেক বছর ধরেই ও সেখানে কাজ করছে। ও যে রেষ্টুরেন্টে কাজ করে এটা বেশ গর্ব করেই সে বলছে। খুব অবাক হলাম দেখে। সব কাজই ওদের কাছে কত সম্মানজনক। ওদের কাছে ছোট কাজ বড় কাজ বলে কিছু নেই, সব কাজই কাজ।

এখানকার সবচেয়ে ভালো জিনিস যেটা, সেটা হলো যার বেশি আয় তাকে বেশি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। যার কম আয় তাকে কম টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। আবার যাদের নিম্ন আয়। তারা ট্যাক্সের টাকা ফেরতসহ আরও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পায়। এতে যেটা হয়, উচ্চ এবং নিম্ন আয়ের লোকের আয়ের পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল হয় না। এখানে যেকোনো কাজ করেই মানুষ সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারে। নিজের চলার খরচ বা পড়াশোনার খরচ নিজেরাই জোগাড় করতে পারে। বাবা-মার উপর চাপ পরে না। অল্পবয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে এবং সব কাজকে সম্মান করতে শিখে। কাজ হলো ওদের কাছে জীবিকার মাধ্যম, সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি নয়।

লেখক : আইরিন পারভীন, কানাডা প্রবাসী

Advertisement
Share.

Leave A Reply