fbpx

চা খাবেন? ঢেলে দেই?

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে আমি বিখ্যাত ওয়াজ শিল্পী তাহেরির কথা বলছি। আসলে আমার লেখার প্রসঙ্গ চিত্রনায়িকা পরীমনি এবং তাঁর সঙ্গে ঘটা অপরাধ। এখানে চা কীভাবে আসলো কিংবা তাহেরির ডায়লগ কেন বললাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

পরীমনিকে আমি রোজ দেখতে পেতাম আমার কর্মক্ষেত্র ত্রিশাল থেকে ময়মনসিংহে বাসে আসার পথে আমার মায়ের প্রিয় সাবান স্যান্ডেলিনার বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে। টেলিভিশন তেমন দেখা হয় না, তাই জানি না পরীমনি লাক্সের বিজ্ঞাপন করেছেন কিনা। ছোটবেলা থেকে দেখেছি যে চিত্রনায়িকা লাক্সের বিজ্ঞাপন করেন তিনি আসলে সুপারস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বলে ধরা হয়। পরীমনি অভিনীত একটি ছবিই আমি দেখেছি, ছবির নাম স্বপ্নজাল। সেখানে পরীমনিকে দেখে আমার যা মনে হয়েছে তা হলো “গ—ড, শি’জ গর্জিয়াস”। তিনি কত বড় স্টার সে সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানি না। তাঁর সঙ্গে ঘটা অপরাধের পর যতটা আলোড়ন হতে পারতো ততটা হয়নি বলেই আমার এখন মনে হচ্ছে তিনি হয়তো অত বড় তারকা নন। কিংবা তাঁর পাশে না দাঁড়ানোর পেছনে ভিন্ন কোন কারণ রয়েছে।

সাধারণত সিনেমার নায়কনায়িকাদের সম্পর্কে আমাদের জনমানুষের মনে কৌতূহল আর আগ্রহ খুব বেশি থাকে। তাঁদের প্রেম, বিবাহ, সন্তান জন্ম কিংবা বিচ্ছেদ- সবকিছু নিয়েই ভক্তরা আলোচনা করেন। নটিং হিল ছবিটা যদি দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, উইলিয়ামরূপী হিউ গ্র্যান্ট অ্যানা স্কটরূপী জুলিয়া রবার্টসকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে পাশের টেবিল থেকে আসা কথাবার্তা শুনে খুব কষ্ট পেয়ে যান। পাশের টেবিলের লোকগুলো চিত্রনায়িকা অ্যানা স্কট সম্পর্কে কথা বলার সময় বলছিল, সিনেমার নায়িকারা আসলে প্রায় সবাই প্রসটিটিউট। এই ছবিটা না দেখা থাকলে আমি ভাবতাম, হয়তো আমরা বাংলাদেশিরাই এরকম ভাবি, আসলে পশ্চিমেও আমজনতার ধারণা নায়িকা মাত্রেই শরীর বিক্রি করে থাকেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা তাঁর ‘সতীরই কেবল ধর্ষণ হয় সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার সামাজিক বাস্তবতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন তিনি যখন গবেষণার কাজে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন অভিযুক্ত বারবার একই কথা বলেন, “সে ভাড়াইট্টা… ভাড়াইট্টা নষ্ট হয় ক্যামনে?” বেশ্যা বা দেহপসারিনীকে ধর্ষণ করা যায় না এই প্রায় প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ধারণার সাপেক্ষে পরীমনিকে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা করাই যাবে না। কেননা এই সমাজ বিশ্বাস করে নায়িকা মানেই বেশ্যা আর বেশ্যাকে তো নতুন করে ‘নষ্ট’ করার কিছু নেই।

এখানে বলে রাখা ভালো, রেইপের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ধর্ষণ বহুল ব্যবহৃত হলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বলাৎকার শব্দটি অধিক উপযুক্ত। ধর্ষণের সঙ্গে যে বল প্রয়োগের সম্পর্ক রয়েছে, এটি যে যৌনতা সম্পর্কিত ব্যাপার নয়, বরং ক্ষমতা প্রয়োগ এবং নির্যাতন সম্পর্কিত ব্যাপার তা একটু বেশি প্রকাশ করে এই শব্দটি। বল প্রয়োগ তখনই করতে হয় যখন এক পক্ষ সম্মত নয়। ধর্ষণের সঙ্গে সম্মতির সম্পর্ক এই যে, যৌনকর্মে এক পক্ষ সম্মত না হলেই অন্য পক্ষ বল প্রয়োগ করে এবং এই বল প্রয়োগের ফলে সে যৌনসুখ পাক বা না পাক, স্যাডিসটিক প্লেজার পেয়ে থাকে। এই ‘সম্মতি’ সংক্রান্ত ব্যাপারটা বোঝা খুব সহজ হলেও আমাদের সমাজ কেন এটা বুঝতে চাচ্ছে না তা আবার আমি বুঝতে পারছি না।

পরীমনি কেন উক্ত ক্লাবে অমি নামক ব্যক্তির সঙ্গে পার্টিতে গেল- এমন প্রশ্ন অনেককে করতে দেখলাম। বলা বাহুল্য, এসব ফেইসবুক পোস্টের মন্তব্য এবং প্রতি মন্তব্যের আলাপ। বাসায় বসে টিভি দেখতে দেখতে কিংবা টয়লেটে বসে মলত্যাগ করতে করতে, যে যেভাবেই এসব মন্তব্য করুক, তার মনোভাব বোঝা যায় খুব সহজেই। ‘সারারাত সালিশ শেষে তালগাছ আমার’ এর মতো বটম লাইন হচ্ছে ‘পরীমনি গেল কেন’। অর্থাৎ কিনা দোষ পরীমনির কিংবা উনার বুদ্ধির বা বুদ্ধিহীনতার। ধরেই নেওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে বেড়াতে গেলে, কিংবা মদ্যপান করলে কিংবা একান্তে সময় কাটালে তার সঙ্গে শয্যায় যেতে সেই নারী সম্মত আছেন। এই ভিক্টিম ব্লেইমিং চর্চা থেকে বের হতেই পারছেনা বাংলাদেশের জনগণ। ভিক্টিম ‘সম্মতি দিয়েছিলেন’ ধরে নেওয়া মানুষেরাই পরীমনির দোষ খুঁজে পাচ্ছে পুরো ঘটনায়।

এই ‘সম্মত আছেন’ ধরে নেওয়াটাই মূল ঝামেলার জায়গা। সম্মত থেকে কোথাও গিয়েও শেষ মুহুর্তে নারী যে অসম্মতি জানাতে পারেন সেই ধারণাটিই এই সমাজে নেই। ইংরেজিতে একটা টার্ম আছে ‘ডেইট রেইপ’। পশ্চিমের দেশগুলোতে নারী ও পুরুষ পরস্পরকে পছন্দ করে একান্তে সময় কাটাবার উদ্দেশ্যে কোথাও দেখা করলে সেটাকে ডেইট বলা হয় এবং সেই দেখাগুলোর আসল উদ্দেশ্য থাকে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করা। অনেক ক্ষেত্রেই সেই ডেইটগুলোতে যৌনসম্পর্ক পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনাও স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তাহলে ডেইট রেইপ টার্মটা আসলো কীভাবে? এই টার্ম আসলো কারণ ডেইটে গেলেই যে সেই পুরুষের সঙ্গে শয্যায় যেতে নারীটি সম্মত তেমন নাও হতে পারে, এবং সম্মত না হলে, তিনি মদ্যপ বা অচেতন অবস্থায় থাকলে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম রেইপ হিসেবে বিবেচিত হবে। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে দেওয়া সম্মতিই সম্মতি। ক্লাবে, ডিস্কোতে, বারে কিংবা নদীর ধারে কফি, মদ বা চুমু খেতে রাজি হলেই যে কেউ যৌনসঙ্গমে রাজি তা ধরে নেওয়া যায় না।

সম্মতি ব্যাপারটি অতি সহজে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ছোট্ট ভিডিও এক সময়ে ভাইরাল হয়েছিল। তাতে বলছে, আপনি কাউকে চা সাধলেন, সে খেতে রাজি হলো, আপনি চা বানিয়ে আনলেন, সে বললো, “খেতে ইচ্ছা করছে না” । তখন আপনি কী করেন? চা-টা কি জোর করে তার মুখে ঢেলে দ্যান? তা তো দ্যান না। সম্মতি ব্যাপারটাও এমন।কেউ আপনার সঙ্গে বেড়াতে গেল, ক্লাবে গেল, মদ্যপান করলো মানেই এই নয় যে সে আপনার সঙ্গে শুতে রাজি, আর শেষ সময়ে খেতে ইচ্ছা করছেনা বললে যেমন কারো মুখে চা ঢেলে দেওয়া যায় না, তেমনিভাবে সেক্সের সম্ভাবনা আছে জেনে, প্রাথমিক সম্মতি দেওয়ার পরেও কেউ সম্মতি তুলে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করা যাবে না এবং চায়ের বেলায় যেমন সে কেন আগে খেতে চেয়েছিল এবং বানিয়ে আনার পর খেতে চাইলো না সেই প্রশ্ন করা যাবেনা, শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। ‘না’ বলার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে। সে নারী হোক, কিংবা পুরুষ, নায়িকা হোক কিংবা বিবাহিতা স্ত্রী।

ডেইট রেইপের মতন ম্যারিটাল রেইপ শব্দটার সঙ্গেও আমরা পরিচিত নই। ফাতেমা সুলতানা শুভ্রার উল্লিখিত প্রবন্ধে তিনি আরোও দেখিয়েছেন যে বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে এবং অভিযুক্ত পরিচিত হলে ধর্ষণ প্রমাণ করা কতটা কষ্টসাধ্য, প্রায় অসম্ভব। সুজান ব্রাউনসমিল তাঁর এগেন্সট আওয়ার উইলঃ মেন উইমেন অ্যান্ড রেইপ গ্রন্থে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে জানান যে ১১ বছরের বালিকা কিংবা ৬৭ বছরের নারীও ধর্ষণের শিকার হন। এমনও নয় যে এই তথ্য আমাদের কারো অজানা ছিল।পত্রিকা খুললে আমরা এমন বহু খবর পাই, সকল বয়সের, সকল লিঙ্গের মানুষ ধর্ষণের শিকার হন। ভিক্টিম ব্লেইমিং কালচারে নারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাঁর অভিযোগকে অবিশ্বাস করা হয়, তাঁর রূপ-সৌন্দর্য, যৌনআবেদন কিংবা যৌনআবেদন প্রকাশ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, এবং এই ধরনের জরিপগুলোকে সচেতনে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কেননা এই তথ্যগুলো সামনে আসলে আর ‘পরীমনি গেলেন কেন?’ ধরনের আজগুবি প্রশ্ন করা যায় না। ধর্ষণ বা বলাৎকার যে যৌন আকাঙ্ক্ষার ফল নয়, বরং ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার সেই সত্যটি প্রকাশিত হয়ে যায়।

ধর্ষণ বা বলাৎকারের সঙ্গে যে ক্ষমতার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা বোঝার জন্য খুব বেশি মেধাবী কিংবা জ্ঞানী হবার দরকার পড়ে না। সাধারণ সংবেদনশীলতা থেকেই বোঝা যায় যে ক্ষমতাবান ধর্ষক হয়ে ওঠে কেননা সে জানে তার জন্য উপায় আছে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার। পরীমনির সঙ্গে ঘটা ঘটনা এটাই আরেকবার প্রমাণ করে, এবং তারপর কোটি কোটি ফলোয়ার থাকার পরেও হাজার খানেক মানুষের তাঁর সঙ্গে ঘটা অপরাধের শাস্তি দাবী না করে উলটো তাঁর পোস্টে হাসির ইমো দিয়ে রিঅ্যাক্ট করা থেকে বোঝা যায় যে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভিক্টিম ব্লেইমিং এর চর্চা আমাদের জাতিগত রোগ হয়ে গেছে। রোক্সান গে সম্পাদিত নট দ্যাট ব্যাডঃ ডিস্প্যাচেস ফ্রম রেইপ কালচার গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন যে বা্রো বছর বয়সে গণধর্ষণের শিকার হবার পর তাঁর অস্তিত্বের অনেকটাই মরে গিয়েছিল। বয়স বাড়তে বাড়তে তিনি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে ধর্ষকরা তাঁকে গুলি করেনি, গলায় ছুরি ধরেনি, মারধোর করেনি, তিনি তো বেঁচে আছেন, বেঁচে গেছেন। তার মানে যা ঘটেছে তা অত খারাপ কিছুও না, এরচেয়ে খারাপ হতে পারতো। কিন্তু এই সংকলন সম্পাদনা করার সময় শত শত লেখা পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার অভিজ্ঞতাগুলো বলার সময় এসেছে, সবাইকে শুনতে হবে “দিস ইজ হাউ ব্যাড ইট অ্যাকচুয়ালি ইজ”।

পরীমনির কান্নার ভিডিও না দেখে, শুধু খবর পড়েই আমার মনে পড়েছে রোক্সান গের কথাটি।

তাহেরির ওয়াজ আমি দেখিনি। ভদ্রলোক সম্ভবত দারুণ পারফরমার। তাই তাঁর বলা সাধারণ কথা, “চিল্লায়া কন ঠিক কিনা” কিংবা “কোন হই চই নাই” কিংবা “চা খাবেন? ঢেলে দেই?” জাতীয় সংলাপ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছে। সম্মতির সঙ্গে চায়ের তুলনা বোঝাবার ব্যাপারটাকে আমার কাছে ছোট শিশুকে বাথরুমে হিসু করা শেখানোর মতন একটা ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। তবুও তাহেরির চায়ের ডায়লগ দিয়েই মনোযোগ আকর্ষণ করলাম। বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, “ঘোড়ামুখী দেবতা, মাষকলাই ভোগ”। বাংলাদেশের জনগণ যখন অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় বা তাপসী পান্নুর সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্যে পিংক ছবিটা দেখে ফেলেছে কিন্তু সারমর্ম কিছুই বোঝেনি তখন তাদেরকে তাহেরির সংলাপ আর চায়ের উপমা দিয়েই ‘সম্মতি’ বা ‘কনসেন্ট’বোঝাতে হবে বৈকী?
পরীমনির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে থাকা কিংবা নির্বুদ্ধিতা নিয়ে তাচ্ছিল্য দেখাতে থাকা জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যেই আসলে এতগুলো কথা লেখা।

লেখক পরিচিতি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান উম্মে ফারহানা। ময়মনসিংহ শহরে জন্ম। ২০১৬ বইমেলায় ‘চৈতন্য’ থেকে ‘দীপাবলি’ নামে তার প্রথম গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল।

Advertisement
Share.

Leave A Reply