fbpx

ঢাকার হাতি, হাতির ঢাকা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

আল মারুফ রাসেল। জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৩ নভেম্বরে পুরনো ঢাকায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলাবাগানে। পড়াশোনা প্রত্নতত্ত্ব ও আলোকচিত্র নিয়ে। সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালে সমকাল পত্রিকায়। পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন সুন্দরবন বাঘ প্রকল্প ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার অ্যাণ্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন)-এ। তিনি ‘দ্য বঙ্গ প্রজেক্ট’ নামে একটি ইতিহাস গবেষণা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে ‘হেরিটেজ ওয়াক ঢাকা’ সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত।

বাংলার হাতির কদর সেই ইতিহাসের আদিকাল থেকেই। বাংলার হাতি ছিল যেমন রণপটু, তেমনি পরিশ্রমীও। দিল্লি দরবারেও বাংলার হাতির কদর ছিল। সুলতানি আমলে লখনৌ থেকে দিল্লিতে উপহার হিসেবেও হাতি যেত বলে জানা যায়।

তবে ঢাকার হাতি নিয়ে বিশদ লিখতে গেলে খুব বেশি পিছনে ফেরার সুযোগ হয়ত নেই। ঢাকার অদূরে মধুপুরের জঙ্গলে ছিল বুনো হাতির পাল। তবে ঢাকা বিখ্যাত হয়েছিল বুনো হাতি নয়, যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত হাতির সরবরাহের কারণে।

মুঘলরাই মূলত ঢাকায় হাতির পিলখানা স্থাপন করে। সেই যে মুঘলরা হাতির ব্যবহার শুরু করে, তার ধারাবাহিকতা চলে এই দেশভাগ পর্যন্ত। সম্রাট আকবরের ছিল হলকা নামের এক হাতির বাহিনী। আবার তার নিজের ব্যক্তিগত হাতির দলও ছিল বলে জানা যায়। এ দলের নাম ছিল ‘খাসা’। আর হাতি বাহিনীর প্রধানের পদবী ছিল ‘শান-ই-ফিল’।

সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন ঢাকায়। তখন থেকে ঢাকাতেও হাতির কদর বাড়ে রাজকীয় ও যুদ্ধবাহন হিসেবে। অবশ্য এর আগেও যে ঢাকায় হাতি দেখা যেত না, তা নয়। বেশির ভাগ হাতিই ছিল দলছুট ও বুনো। তবে জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই বুনো হাতি খেদার মাধ্যমে ধরে পোষ মানানোর ব্যবস্থা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। পোষা হাতি দিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতি ধরে প্রশিক্ষিত করার রীতি তখন থেকেই চালু হয় পুরোদমে। সে সময়ে এই বিভাগের নাম ছিল খেদা আফিয়াল।

ব্রিটিশ আমলে এসে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার কমে এলেও হাতি ধরা থেমে থাকেনি। ভারি মাল পরিবহন আর আদিবাসী অধ্যুষিত দুর্গম এলাকায় অভিযানে হাতি ছাড়া আর কি ছিল? ১৮২৪ সালে বিশপ হেবারের ঢাকা ভ্রমণের বর্ণনায় আমরা পাই যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবল ঢাকার থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বছরে অন্তত তিনশ হাতির যোগান দিত। বিশপ হেবারের বর্ণনা থেকেই জানা যায় যে, ঢাকার হাতির পানি খাওয়া আর গোসলের জায়গা ছিল এখনকার সদরঘাট এলাকা।

ঢাকার হাতি, হাতির ঢাকা

১৮১৪ সালে ঢাকার হাতি, আঁকিয়ে জর্জ চিনারি

ঢাকায় হাতি রাখা হত পিলখানা এলাকায়। জায়গার নাম এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। ফার্সি ভাষায় ‘পিলখানা’র অর্থ হাতির জায়গা। বুড়িগঙ্গা ছাড়াও পিলখানার হাতিদের স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হত কাছাকাছি একটা ঝিলে। লোকমুখে তার নাম হয়ে যায় হাতিরঝিল। যেটা এখন নতুন করে সাজানো হয়েছে ঢাকাবাসীর বিনোদনের জন্য। গোসলের পর এই হাতিবাহিনীর গন্তব্য ছিল বাগ-ই-শাহী বা শাহবাগের রমনায়। রোদ পোহানো আর ঘাস-বাঁশ চিবিয়ে সন্ধ্যায় হাতি ফিরে যেত পিলখানায়। হাতির পালের যাতায়াতের পথটা পড়ে গিয়েছিল লোকালয়ের ভেতর দিয়ে। তাই বাড়িঘর ভাঙাসহ ফসলেরও ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে যেত। শেষে এই ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে হাতির পালের যাতায়াতের জন্য তৈরি হল নতুন পথ। সাহেবি আমলে তৈরি বলে নামও হল ইংরেজিতে- ‘এলিফ্যান্ট রোড’। ঐ রাস্তায় এক জায়গায় নালার উপর সাঁকো ছিল, যেটা কালের আবর্তে রেললাইনেও পরিণত হয়েছিল। লোকমুখে তাই হয়ে গেল হাতিরপুল। এই হাতির তদারকির জন্য নিয়োজিত মাহুতদের ঘর ছিল আবুল হাসনাত সড়কে মাহুতটুলি এলাকায়।

জিপি স্যান্ডারসন ঢাকায় হাতি ধরে গেছেন, তার বর্ণনা রয়েছে তার লেখা বইয়ে। তিনি ১৮৭৫ সালে ঢাকায় আসেন। তখন গোয়ালন্দ থেকে ঢাকা দুদিনের পথ। রাতে নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকত। কারণ রাতে খরস্রোতা নদীতে নৌকা চালানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি নদী থেকে ঢাকার সিটিস্কেপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ঢাকা ছিল বাংলা খেদার প্রধান কার্যালয়। তিনি পিলখানায় হাতি কিভাবে রাখা হত,যত্নআত্তি কিভাবে করা হত তারও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তবে হাতি যে সে সময়েও কমে আসছিল তার বর্ণনাতেই তার প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, ১৮৭৫-৭৬ সালের আগে সাত বছরে গড়ে প্রতি বছরে হাতি ধরা পড়েছে ৫৯টি করে। আর এর আগে ১৮৩৬-৩৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৯। তিনি আঠারো মাসের জন্য ঢাকার হাতি খেদার ভারপ্রাপ্ত প্রধান হলেও কাজ করতে পেরেছিলেন মাত্র নয় মাস। কারণ এরপই তাকে মহীশূরের হাতির দায়িত্ব নিয়ে আগের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে হয়। তবে ফিরে যাওয়ার আগে ঢাকা তথা বাংলার বন্যপ্রাণি আর হাতি খেদা নিয়ে মূল্যবান সব তথ্য সংকলন করেন।

ঢাকার হাতি, হাতির ঢাকা

জোসেফ স্কট ফিলিপের আঁকা ১৮৩৩ সালে শহরে হাতি

সে ঢাকা আর নেই এখন। হাতি দূরে থাক, মানুষেরই টেকা দায় এ শহরে। এক সময় কিছু সার্কাসের দলের হাতি শহরে দেখা যেত। সার্কাস দলও এখন বিপন্ন বাংলায়। হাতির পালক মাহুত সম্প্রদায়ও বিলুপ্ত। তবে কিছু মাহুত নিজ উদ্যোগে হাতি পালে এখনও। খাবার নেই, চলে হাতি নিয়ে চাঁদাবাজি। সংবাদমাধ্যমে তার খবর পাই। হাতি দেখতে হলে এখন একমাত্র গন্তব্য মিরপুর চিড়িয়াখানা।

শুধু এই শহরের কিছু জায়গার নামে শুধু টিকে আছে এই স্থলচর বৃহত্তম এই স্তন্যপায়ীর অস্তিত্ব। তখন ভাবি, এ শহর কি কখনও কাঁদে অনেক হারানো নি:স্ব মানুষের মতো?

Advertisement
Share.

Leave A Reply