fbpx

পথ, পা ও যাওয়া না যাওয়ার দ্বিধা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

নদী লিখলেই নৌকা ভেসে যায়, মাঠ লিখলেই হাওয়া ছুটে আসে, বৃষ্টি লিখলে ভিজে যায় কবিতার খাতা; যেমন, আগুন শব্দটি উচ্চারণমাত্রই কিছু না কিছু পুড়ে যাওয়ার ইতিহাস দৃশ্যমান হয়। পথ লিখলেই পা চলে আসে, ডাকে গন্তব্য। কিন্তু কবি বললেন, ‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে’_কবি বললেন, ‘আমার শরীর ভরা নদী, সে নদী কেবল জলের গান গায়’, ‘সারাদিন ঘুরি, কোথায় ঘুরি জানি না, এই যে পথ, কিসের পথ এইসব? পথ শুধু ঘরে নেয় না, বাইরেও টানে’। কবির পায়ের ছাপে মস্ত আকাশ এবং আকাশ উপুড় হয়ে আছে চিরকাল…’।
পায়ের ছাপে মস্ত আকাশ? কোথায় পা পড়েছে কবির?

ভাষা-কাঠামোই এমন যে, সে-কাঠামো সর্বোচ্চ কবির দখলে থাকে। শব্দ ব্রহ্মাস্ত্র, অবলীলায়, কবির হাতে। মানুষের অনুভূতিও এমন, এবং যা অদৃশ্যত। চিত্রকর রঙে আঁকেন, কবি শব্দে ধরেন। একটি শব্দ এসে পরবর্তী শব্দকে পাশে বসিয়ে আবার একটি শব্দের সন্ধানে এগোতে থাকে, বাক্য দাঁড়িয়ে যায়। শ্লোকে পড়েছি, বাক্য ঈশ্বর হয়ে ওঠেন। বাক্য শব্দ ছিলেন, শব্দ ধ্বনি ছিলেন, আদিতে ধ্বনি ছিলেন ওঙ্কার! বলতে ইচ্ছে করছে, নার্সারিতে অনেক ফুলগাছের চারা আছে ঠিকই, কিন্তু নয়নতারা তো ফুটে আছে অন্য কোথাও, হয়তো অজ্ঞাত দেয়ালে; অধুনা মানুষের ভিড়-সমাগমের ভেতরে চুপচাপ ঘোরাফেরা মানুষটি, কবি, ‘নৈমিত্তিক খুচরো জীবন’এর মধ্যে থেকেও যিনি বলছেন, ‘আমরা মরে গেছি জন্মের বহু আগেই কিম্বা মৃতদের মহল্লায় ঢুকে পড়েছি অনুচ্চারিত সংলাপে, উৎসবে। এই ভরা পার্বণে ঢেউ ও পাথরের কান্না এক হয়ে জন্ম নিয়েছে করুণ বাঁশি, সমুদ্র।’ এভাবে বলতে পারেন শুধু কবি। এভাবে অনুভূতিকে নির্ণয় করেন কবি। তাই সকল লোকের মাঝে বসে নিজেরই মুদ্রাদোষে কবি আলাদা হয়ে যান। একে কবির নিয়তি বলে আমরা মীমাংসা পেতে পারি হয়তো। কবি বলেন, ‘যেমন মাছিরা হাতে বসে, রক্ত খায়, খেয়ে খেয়ে পড়ে থাকে তেমনি খেয়ে গেছে রক্তের কুটুম্ব আমার! চোখ খুলে দেখি, রাত্রি চলে গেছে, দিন চলে গেছে, ঘড়ির কাঁটায় থেমে আছে উষ্ণতার উর্ধগামী স্রোত, কোথাও কেউ নেই। তবু মনে হয়, কেউ আছে, আছে। কেউ কেউ না থেকেও আছে, খুব ভেতরে, গোপনে। থেকেও নাই হয়ে গেছে…’ এভাবে বলেন কবি, তার নতুন কাব্যগ্রন্থে। কবি মালেক মুস্তাকিম। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে।’

‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে’ শিরোনামের আওতায় লিপিবদ্ধ গ্রন্থের ৫৪ টি কবিতাই। যদিও প্রত্যেকটি কবিতাই নিজের মতো করে জন্ম নিয়েছে। কবিকে সময়ের কোনও চোরাস্রোত বা একটা ঘোর হয়তো এই কবিতাগুলো লিখিয়ে নিয়েছে। মালেক মুস্তাকিম নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে যে অনুভূতিকে চিত্রিত করেন, অনুভূতির মধ্যে চিকচিক করে প্রজ্ঞা, দর্শন। সেই অনুভূতি নৈর্ব্যক্তিকায় পৌঁছয়, সেই বোধ-বাস্তবতা তখন কবিতা। কবিতার রসে সিঞ্চিত পাঠক তখন মুখোমুখি ‘আমরা কেবলই একা হতে চাই, একাকীত্বই হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতি আমাদের-ঝাঁকের ভেতরে থেকেও একা একা উড়ে যায় গাঙচিল…জলের ভেতরে থেকেও মাছেদের চোখে পৃথক খরা- একা একা কপাট খুলে মাছেরা পেতে রাখে গেরস্থালি, যদি ফিরে আসে হঠাত হারিয়ে যাওয়া গত বর্ষার চাপাতি, উড্ডীন জলের নুপুরতা…’ নিজের সঙ্গে কথা বলেন কবি। নিজের কথা নিজেকে শোনান? মনের মধ্যে গুঞ্জরিত অভিপ্রায় ফোটে কবিতায়, কবির ক্ষমতা-দক্ষতা-নিপুণতা সাপেক্ষেই তা প্রকাশিত হয়। এবং পাঠকের মধ্যে তা সঞ্চারিত করে। পাঠকেরও ক্ষমতা-দক্ষতা-প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞান সবার একাকার নয়। ক্রমশ পরিণত পাঠক তার পাঠস্তরকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যান, স্বাভাবিক। কবিতার পাঠক সাধারণতই পাঠক হিসেবে বনেদি। বিষয়টি হচ্ছে, কোন কবির কবিতার রস নিচ্ছেন কোন স্তরের পাঠক। কিম্বা স্তর-ফিস্তর কিছুই না, ভালো লাগার ব্যাপার। কিন্তু সেই ভালো লাগাতেও সব মীমাংসা হয় না হয়তো। পাঠক হিসেবে এত বড় কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে লিখলেন, ‘তোমার কবিতা চিত্ররুপময়, তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ হয়ে গেল? রবীন্দ্রনাথ কি জীবনানন্দকে ধরতে পারলেন না? বুঝতে পারলেন কম? নাকি অনুজের প্রতি স্নেহময় অবজ্ঞা! নাকি নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া মিহি কোনও ঈর্ষা? নাকি তেমন কোনও দায়দায়িত্ব থাকে না অনুজের দিকে সময় দিয়ে তাকানোর? নাকি সেই সময় আর থাকে না অগ্রজের, যেহেতু জীননের আয়ু বড় সীমিত, তাই? মালেক মুস্তাকিমের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হলো, খুব ভালো লেখা। এই কবি তার নিজের একটা ভাষা গড়ে তুলছেন, জীবনের প্রেম-কাম-স্বেদবিন্দু রোপণ করে বাগান গড়ে তুলছেন_ অথচ আমি খেয়ালই করিনি। এই খেয়াল না করাই অগ্রজের এক ধরনের শ্লাঘা হয়ে আছে বাংলায়, শতবছর আগের মতোই, এখনো।

যেমন প্রেমিক, রোদ-দুপুরে ঘামতে ঘামতে রাস্তা দিয়ে হাঁটে বলেই প্রেমিক; তার পাঁজর ভর্তি অফুরন্ত ভালোবাসা ও যন্ত্রণা; তরুণ কবিরও বুকের মধ্যে বনভূমি, সেই বনভূমির মধ্যে এখন দুপুর, বিস্তীর্ণ নির্জনতা, পাতা ঝরার গান সেখানে আছে, নিঃসঙ্গতা আছে, সেহেতু হাহাকার আছে। সেই হাহাকার আকার পায় কবিতায়। সেই হাহাকার হাওয়া হয়ে আসে, জানলা দিয়ে, ঘরে। পাঠক ঘোরের মধ্যে থেকেই কবিতা পড়তে পড়তে হাহাকারের হাওয়ায় দুলে ওঠে। মালেক মুস্তাকিম আমার অনুজ কবি। তার কবিতার সঙ্গে আমার এতদিন বোঝাপড়া হয়নি। মেলায় প্রকাশিত হলো মুস্তাকিমের সপ্তম কবিতার বই ‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে’। যারা কবিতার পাঠক, তাদের জন্যে বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ, বাংলাবাজার থেকে। মালেক মুতাকিম তরুণ কবি। কবি চিরকালই তরুণ। তরুণ কবিই তো অনাবিষ্কৃত আনন্দ আনেন কবিতায়। অনুদ্ঘাটিত সংবেদনশীলতার শৈলী ঝাঁ ঝাঁ করে তরুণ কবির উচ্চারণে। আর ভালো কবিতা তো উচ্চারিত হয় নদীদের ফিসফিসানির মতো, শহরের নির্ঘুম জানালার ছটফটানির মতো, দীর্ঘ করিডোরের নিঃসঙ্গতার শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো। মালেক মুস্তাকিমের কবিতার মধ্যে ডুব মারলে সেই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গীত পাওয়া যাবে_ দারুণভাবে একজন মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যে ঠেলে দেবে। কবি বলেন, ‘কোথাও যাব বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে বহুদিন আমি আর কোথাও যাইনি, ফিরে এসেছি, নিজের কাছে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও যাওয়ার জায়গা নেই…নিজেকে খোঁজার ভয়ে নিজের কাছেও যাওয়া হয় না…’

ফাল্গুন দিনের শুভেচ্ছা জানাই কবি মালেক মুস্তাকিমকে, তার নতুন কবিতার সঙ্কলন ‘আমি হাঁটতে গেলে পথ জড়িয়ে যায় পায়ে’ একটি ভালো কাব্যগ্রন্থ _এটাই আমার ভালো লাগা। কবিতা ভালো লাগাকে উত্তীর্ণ করে_ যা কবিতারই ক্ষমতা।

Advertisement
Share.

Leave A Reply