করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে প্রতিবন্ধীদের ভাতা নিয়ে নানা দুর্নীতি ও সমাজসেবা কার্যালয়ের কার্যক্রমের নানা অসঙ্গতির তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির গবেষণায়।
১১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ‘উন্নয়নে অন্তর্ভূক্তি ও প্রতিবন্ধিতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সভায় গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন টিআইবির চেয়ারম্যান মো. ইফতেখারুজ্জামান।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই গবেষণা চালানো হয়।
টিআইবির গবেষণায় উঠে আসা চিত্র:
১. রাষ্ট্রীয় খাত থেকে বঞ্চিত প্রতিবন্ধীরা
রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট না। যেটুকু বরাদ্দ থাকে তা আবার অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না।
২. প্রতিবন্ধীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত
প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিদ্যালয় নেই। সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পাঁচটি, সরকরি বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আটটি, এমপিওভুক্ত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় জেলার সদর উপজেলাকেন্দ্রিক।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে অনেকক্ষেত্রে পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ টিনসেড ভবনে পাঠদান কার্যক্রম হয়। অনেক বিদ্যালয়ে মাঠ নেই এবং থেরাপির জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ মেশিন অকেজো।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দরিদ্র প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ফোন না থাকায় অনলাইন ক্লাসে তারা অংশ নিতে পারেনি। দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকার কারণে একটি অংশ স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের সরকারিভাবে ২,৫০০ টাকার অর্থ সহায়তার তালিকায়ও রাখা হয়নি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।
৩. চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত
সরকারি হাসপাতালগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তাররা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চিকিৎসায় আন্তরিকতা দেখান না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরক্ত হন।
কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তাররা প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণের জন্য ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৪. গণপরিবহনে বৈষম্য
গবেষণা অনুযায়ী, গণপরিবহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা সংরক্ষিত আসন থাকা সত্ত্বেও তারা তাতে বসতে পারেন না। একইসাথে প্রতিবন্ধী ও তাদের অভিভাবকদের অনেক সময় গণপরিবহনে খারাপ আচরণের সম্মুখীন হতে হয়।
৫. অন্তর্ভূক্তি ও ভাতা পাবার ক্ষেত্রে দুর্নীতি
জেলা বা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তালিকায় প্রতিবন্ধিতার নাম অন্তর্ভূক্তকরণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা তার আত্মীয়ের কাছ থেকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা অন্যায়ভাবে আদায় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতি মাসে প্রতিবন্ধীদের ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেয়া হয়, যা জীবন যাপনের চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
এদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ প্রতিবন্ধীদের ভাতা সুবর্ণকার্ড তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতদের দেয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়কে প্রভাবিত করেন। ফলে, যাদের সুবর্ণকার্ড পাবার কথা নয়, তারাও প্রতি মাসে ভাতা নিচ্ছেন, বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিবন্ধীরা।
ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সুবর্ণকার্ডের জন্য ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার ওপর। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগের কথা উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে নতুন যে ২ লক্ষ ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছে, তাদের অনেকেই ভাতার পুরো অর্থ পাচ্ছেন না, সে ভাতার অংশবিশেষ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমান পেয়েছে টিআইবি।
৬. অভিযুক্ত প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনও
প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন শর্তসাপেক্ষে এনজিওদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সাহায্যপ্রাপ্ত অনেক এনজিও ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে অনুদান পেয়ে থাকে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবারের ভার্চুয়াল সভায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে দুঃখজনক যে, প্রতিবন্ধীতাসহ ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে সরকারি নীতি-নির্ধারণী থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি, যার ফলে এ ক্ষেত্রে যারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাসমূহ পাওয়ার কথা, অধিকার প্রাপ্তীর তাদের যে নিশ্চয়তা রয়েছে, সেটি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয় না।’
প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলেও মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ১৪ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করছে টিআইবি-
১. আইন ও বিধিমালার সময়োপযোগী সংস্কার এবং আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে;
২. জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতা সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে।
৩. চাহিদার নিরিখে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে;
৪. সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, গণশৌচাগারসহ সংশ্লিষ্ট সকল অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে হবে; ৫. জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ইউনিট করতে হবে;
৬. প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিশেষায়িত বিদ্যালয় এবং প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
৭. প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;
৮. প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে;
৯. সকল ধরনের দুর্যোগকালীন সময়ে প্রতিবন্ধিতাসহ শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনধারণের মৌলিকা চাহিদা পূরণে সরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
১০. প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;
১১. প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিতে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সংঠনের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে;
১২. সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তথ্যবহুল করতে হবে ও তথ্যসমূহ নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে;
১৩ ও ১৪. প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের সেবা প্রদানকারী সকল কার্যালয়ে কার্যকর তদারকি এবং অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে জবাবদিহিমূলক নিয়মিত নিরীক্ষা নিশ্চিত এবং প্রতিবন্ধিতা সংশ্লিষ্ট সেবায় দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।