fbpx

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

কবি বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়। প্রাণবন্ত প্রকৃত সারস পাখি জানে মানুষের স্বভাব। যতটা না সৌন্দর্য প্রিয় তারা, তার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক এই জাত। শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির দাবিদার এই মানুষজাত। কিন্তু তার নৃশংসতার কথা শুরু হলে অগণন রাত ভোর হয়ে যাবে। তবু ফুরাবে না মানুষের নি:চিহ্ন করে ফেলা আক্রমণ প্রবণতার ইতিহাস কিংবা বর্তমান। আজও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দ মারণাস্ত্রখাতে। পারমাণুবিক বোমা ও জীবাণু অস্ত্রের উদ্ভাবক মানুষজাত। স্বজাতির ওপর এর প্রয়োগও চলেছে। কখনও সমুদ্রের হাজার ফিট তলে চলে এ নিয়ে নিরীক্ষা। এ পর্যন্ত দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে এ গ্রহ। স্বপরিমণ্ডলের কথা এসব। অন্তরীক্ষের তথ্য তো পাওয়া যায় না। বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার ৯০ শতাংশই ব্যয়িত হয় সামরিক প্রয়োজনে। সেই জাত গ্রহচারী হয়ে নভোমণ্ডলে ফুলের আবাদ করবে তা মানা দুস্কর। স্বর্গতূল্য বসুধার কত প্রাণ- প্রজাতি, পাহাড়, বরফ, সমুদ্র,নদী মানুষের হাতে নি:শেষ হয়েছে তা সংরক্ষণ সম্ভব নয় কোনো সার্ভার বা মুদ্রিত বইয়ে। এখনও আমাজন ছাই হয়। ছিদ্র হয় উপরের আয়নোস্ফিয়ার। এই তো মানুষ! এই তো তার শ্রেষ্ঠত্বের কীর্তি!

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

টেকনাফেও পাহাড় থেকে বুনো হাতি নেমে আসে। ছবি : সংগৃহীত

এবার দেশের একটি নির্দিষ্ট উপকূল ও পার্বত্য অঞ্চলের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ ও এর ভারত, মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন ন্যাচার (আইইউসিএন)এর তথ্য মাফিক, বিশ্বের মহাবিপন্ন ঘোষিত প্রজাতি এশিয় হাতির দুই তৃতীয়াংশের বাস এ অঞ্চলে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বন বিভাগ ও আইইউসিএন – এর এক যৌথ জরিপে জানা যায়, এ জনপদে হাতির সংখ্যা প্রায় ৩৩০ টি। স্থলচর স্তন্যপায়ী বৃহত্তম এই প্রাণিটির বিপন্ন আর্তনাদ মানুষ শোনেনি। বাংলাদেশ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, গত এক বছরে দেশে (নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত) ১৮টি হাতি মারা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার অঞ্চলেই অন্তত ১৩টি বুনো হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর কারণও প্রতিবেদনে উল্লেখিত- ‘কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে রেললাইন, রোহিঙ্গা বসতি, বিভিন্ন প্রকল্প, অবৈধ জবরদখলসহ বিভিন্ন কারণে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস, পর্যাপ্ত খাদ্যাভাব, চলাচলের করিডোর চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হয়েছে।’ যে কারণে তারা মানুষের জনপদে পা ফেলেছে। যে মানুষ নিধণে স্বিদ্ধহস্ত।

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

বুনো হাতির এলাকায় মানুষের হানা। তাই হাতি লোকালয়ে। ছবি : সংগৃহীত

হাতিদের খুন করা হয়েছে নানাভাবে। কোথাও পিটিয়ে, কোথাও গুলি করে, কোথাও ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে। এ বছরের ২৭ মে পাশের ভারতের কেরালার মলপ্পুরমে একটি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে আনারসের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে খাওয়ানো হয়। একবারে শেষ করা হয়নি ওকে। ধাপে ধাপে তীব্রতম যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে ৫ জুন মৃত্যুবরণ করে এই মা হাতিটি। মৃত্যুর বিবরণও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও সোশাল মিডিয়ায় আলোচিত হয়ে অনেকের হৃদয়ক্ষরণ ঘটায়। তারাও মানুষ বলে রাখছি।

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

কেরালার আলোচিত সেই মা হাতি। ছবি : এনডি টিভি

‘…মুখের ভিতর বাজি ফেটে যাওয়ায় হাতির চোয়াল মারাত্মক জখম হয়ে ঘা হয়ে যায়। যার জেরে হাতিটি দু’সপ্তাহ খাবার ও জল খেতে পারেনি। নদীতে হাতিটি ডুবে থাকার সময় ফুসফুসে জল ঢুকে যায়। দুর্বল হাতিটি ধীরে ধীরে মারা যায়… ‘ : এই সময়, অনলাইন ভার্সন। ৫ মে, ২০২০। হাতি খতমে কেউ পিছিয়ে নেই। যতো বিশাল ও হোক আর গণেশ নামে পূজিত হোক ওপাড়ে। গত ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বসেন। সেখানে তাদের আলোচনা শেষে ৭টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর একটি বিবেচিত হচ্ছে এই হাতি রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা হিসেবে।

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : সংগৃহীত

সেদিন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে এক প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। গণমাধ্যম বরাতে জানা যায়, ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসময় বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন যথাক্রমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান এনডিসি ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। প্রটোকল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দীন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব দীপক কুমার চক্রবর্তী প্রমুখ। প্রাণ প্রজাতি ও হাতি সংরক্ষণ নিয়ে গবেষকদের মতে, দু’দেশের মধ্যে সম্পাদিত এই প্রটোকলের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত হাতির চলাচল নির্বিঘ্ন হবে এবং হাতি সংরক্ষণ কার্যক্রম সহজতর হবে। এছাড়াও হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে এই প্রটোকল স্বাক্ষর কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এলিফেন্ট কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যানের মূল প্রণেতা আইইউসিএন বাংলাদেশে কর্মরত আশরাফুল হক বলেন, বিপন্ন হাতি বাঁচাতে এটি একটি শুভ উদ্যোগ।

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

বাংলাদেশ এলিফেন্ট কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যানের মূল প্রণেতা আশরাফুল হক। ছবি : ফেইসবুক

তিনি বলেন, এর প্রাথমিক কাজটি শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। আইইউসিএন বাংলাদেশ ও বনবিভাগের যৌথ গবেষণার মাধ্যমে প্ল্যানটি সূচিত হয়েছিল। আমরা সেখানে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তিনি বলেন, বন্য হাতি কোনো সীমানা মানে না। তারা যেখানে খাদ্য সেখানে বিচরণ করে। আমরা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করি, নির্দিষ্ট কোনো দেশের পক্ষে আন্ত:সীমান্ত হাতি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এর জন্য বাংলাদেশ, ভারত দুই দেশকেই কাজ করতে হবে। ২০১৭ সালে আমরা গবেষণা করে হাতির সীমান্ত পেরোনোর প্রায় ১০/১৫ টি স্থান শনাক্ত করি। এরপর তা অনুযায়ী ২০১৮ সালে একটি খসড়া প্রণয়ণ করা হয়। সেখানে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুই দেশের মধ্যে হাতি বিষয়ক তথ্য বিনিময়ের দিকে আমরা জোর দিই। কারণ, বন্য প্রাণি শনাক্তে ভারত প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা ‘এলিফেন্ট করিডোর’ নামে হাতি বিচরণ করে এমন কিছু এলাকা বের করি। আশরাফুল হক বলেন, কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, বুনো হাতি দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিচরণ করে। শীতে তারা এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, গ্রীষ্মে আবার আরেক এলাকা। তাদের খাদ্য চাহিদাও অন্য প্রাণি অপেক্ষা বেশি। এদিকে তাদের বাসস্থলে মানুষের হানা। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের লোকালয়ে আসতে হয়। লোকালয়ের মানুষও স্বাভাবিক কারণে হাতির ফসল নষ্ট কাণ্ডে ক্ষিপ্ত থাকে। তাই সংঘাত অনিবার্য। আমরা হাতির নিরাপদ অভায়ারণ্যের প্রস্তাব তৈরি করি। যার প্রভাবেই আজকের এই সমঝোতা স্মারক।

প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক ও বুনো হাতির জন্য সুবার্তা

সীমান্তে বুনো হাতি। ছবি : সংগৃহীত

দুই দেশের মধ্যে সাক্ষরিত এই সমঝোতা স্মারক প্রসঙ্গে বন সংরক্ষক ও বন্য প্রাণি গবেষক মিহির কুমার দে বলেন, এই চুক্তির ফলে বিপন্ন হাতি বিষয়ে দুই দেশের যৌথ জ্ঞান বিনিময়ের পথ উন্মুক্ত হবে। আমরা ভারতের সাথে একসাথে কাজ করতে পারব। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চল ও কক্সবাজার ছাড়াও দেশের সিলেট, শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহে হাতির বাস আছে। এই চুক্তির ফলে দুই দেশই হাতি সংরক্ষণে আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হবে। নি:সন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক ঘটনা। দেরিতে হলেও বোধোদয় হলো মানুষের। শুধু হাতি নয়, প্রতিটি প্রাণ প্রকৃতি মিলেমিলে বাঁচুক সুন্দরীতমা এ পৃথিবীতে। শুধু বাংলাদেশ, ভারত নয় প্রাণের এ চক্রে ব্যাঘাত ঘটলে বিশ্বের কোথাও টিকবে না দাপুটে মানুষও। চলমান মহামারীও কি বোধোদয়ের জন্য যথেষ্ট নয়? কবি বিনয় মজুমদার উদ্ধৃত লেখনী বিনয়েই শেষ হোক, “… তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিত হও “

Advertisement
Share.

Leave A Reply