১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে যখন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়, তখন বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ছাত্র-জনসভায় তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘আমার যা বলার তা ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় জনতার সামনে বলবো।’
রেসকোর্সের সেই ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি আরও খোলাসা করে বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো।’ সেই সঙ্গে তিনি গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার আহবান জানালেন। সামরিক বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন সবাই স্বীকার করবেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের কৌশল হিসেবে জনযুদ্ধের কথাই ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এটা তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মীদের সীমাবদ্ধতা বা অদক্ষতাও হতে পারে।
তৎকালীন বামপন্থীরা হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর এই যুদ্ধ-কৌশলের ধারকবাহক। তারা বেশ আগে থেকেই স্বপ্ন দেখতেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। এজন্য তারা রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। আর এই বিপ্লবের আকাঙ্খা ও জনযুদ্ধ গড়ে তোলার জন্য তারা সশস্ত্র হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেন ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের আগে থেকে। তারা জনযুদ্ধ গড়ে তোলার ইচ্ছে পোষন করতেন। এজন্য পাঠ করতেন বিভিন্ন দেশের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল সংক্রান্ত বইপুস্তক।
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে পাকিস্তানের থানা, পুলিশ ক্যাম্প এমনকি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেড়িয়ে আসা অস্ত্র সংগ্রহে মনোযোগও দেন। দাবি করা অমূলক নয় যে, এতে তারা সফলও হন। অসহযোগ আন্দোলন ও তার পরের মাসে পাকিস্তান প্রশাসনের হাতছাড়া হওয়া অস্ত্রশস্ত্রের শতকরা ৭০ ভাগ চলে যায় বামপন্থীদের হাতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনাস্থার কারণে বামপন্থীরা ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে’ জনযুদ্ধ সংঘটিত করতে ব্যর্থ হয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে ভাবতেন, পেটিবুর্জুয়া ও উঠতি বুর্জুয়াদের নেতা। তারা সাধারণ মানুষকে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব থেকে বের করে আনার জন্য অর্থাৎ জনগণকে ‘শিক্ষিত’ করে বামপন্থী বানাতে গিয়ে জনগণ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অক্টোবর, নভেম্বর মাসে এই বামপন্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে ‘পালাতে’ শুরু করেন। কোথাও কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের তাড়া খেয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। ওই সময়ে গণবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ নির্ধারণ করতে গিয়ে বামপন্থীরা এখনো মুজিব তথা স্বাধীনতা বিরোধী রয়েই গেছেন।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অধিকাংশ চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণের ফাঁদে পড়ে সময় অপচয় করেন অন্তত চার/পাঁচ মাস। সারাদেশের ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি দেশের ভিতরে আসার সুযোগ পেতে থাকেন আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে। বিএলএফএফ মুক্তিযোদ্ধাদের বিশাল অংশও আসে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ সমর্থক থেকে। কিন্তু তাদের অবস্থা আরো করুণ। তাদের মাত্র ২১/২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় সাহস অর্জনের জন্য থাকতে হয় দীর্ঘদিন। তারা দেশের ভিতরে আসার সুযোগ পেতে থাকেন অক্টোবর থেকে। যারা ভারত থেকে অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে করতেই সময় ফুরিয়ে যায়। ফলে বঙ্গবন্ধুর দেখানো কৌশলে যুদ্ধ করতে ব্যর্থ হন তারা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকসেনারা যখন সাধারণ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়, তখন ওই বাহিনীর বাঙালিদের একটি অংশ যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। তারাও দ্রুত ভারতের সীমান্ত এলাকায় ঠাঁই নেয়। তাদের অভিজ্ঞতা নিয়মিত যুদ্ধের, ফলে মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে নিয়মিত যুদ্ধেরই। মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী তথা প্রবাসী সরকার মনে করতো, সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে শক্তি সঞ্চয় করে একটি সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে, সে বাহিনী পরাস্ত করবে পাকিস্তানিদের। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা নিয়মিত বাহিনীর কর্মকাণ্ড সীমান্ত এলাকার ১৫ মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী নভেম্বরে এসে যখন উপলদ্ধি করলেন যে, নিয়মিত বাহিনী দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা অসম্ভব, ততদিন পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এ সময়ে গড়ে ওঠে মিত্র বাহিনী। ফলে, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে’ তুলে জনযুদ্ধের কৌশলে মুক্তিযুদ্ধ করা আর হয় না।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত যুদ্ধ-কৌশলে যদি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতো তবে সহজেই নির্মূল হতো এদেশের সকল পরগাছা। হাসি ফুটতো দুঃখী মানুষের মুখে, ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেতো না স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। সপরিবারে আত্মাহুতি দিতে হতো না বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
লেখক : সাইফুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক-কথাসাহিত্যিক, আহবায়ক, সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি