fbpx

মানা যায় এই রসহীন শীত?

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

ইসমাইল গাজী। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুয়ে পড়েছেন। তবে তার সুঠাম দেহে যেন অফুরন্ত বল। আর চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। সাত সকালে বাড়ির উঠানে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে নাতী নাতনীদের সাথে গল্প করছেন। কীভাবে গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করতেন সেই গল্প শোনাচ্ছেন সবাইকে।

‘প্রথমে খেজুর গাছের মাথার অংশের কাছাকাছি ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়ে গাছের ভেতরের রস বের করার জন্য গাছের সাদা অংশ বের করে নিতাম। পরে পরিষ্কার করা সেই সাদা অংশ থেকে বিশেষ কায়দায় মাটির কলস ঝুলিয়ে দিতাম। আর যদি গাছ হয়, তাহলে ঝামেলা আরও বেশি। তখন কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে কলসি ঝুলিয়ে দিতাম’।’

মানা যায় এই রসহীন শীত?

গাছিরা গাছে উঠে খেজুরের রস বের করে । ছবি : সংগৃহীত

আর ঠিক তখনই মাটির কলসি ভর্তি রসের তার হাড়ি সামনে রাখলেন। এক চুমুকেই যেনো পুরোটা সাবাড় করে ফেললেন।

বাড়ির উঠানের আরেক পাশে রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। গুড় তৈরি হবে আর তার সাথে তৈরি হবে রসের পিঠা। রসের এই মন মাতানো গন্ধে চারিদিক যেনো মৌ মৌ করছে। এক মিষ্টি ঘ্রাণ মাতম তুলেছে ছোট বড় সবার মনে।

ইসমাইল বললেন, সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। বন্ধুরা মিলে রাতে গাছ থেকে খেজুরের রস চুরি করতাম। পরে আগুন জ্বালিয়ে আতপ চাল দিয়ে পায়েস রান্না করে খেতাম। বাবাকে রস সংগ্রহ করতে দেখছি সেই ছোটবেলা থেকেই। তখন প্রচুর রস আসত বাড়িতে। খেজুরের গুড়ের গন্ধে মৌ মৌ করত পুরো বাড়ি। কিন্তু বর্তমানে গাছের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে।

তিনি বলেন, আগে গ্রামে এতো গাছ ছিল যে দিন শেষে ফুরসত পেতাম না। তবে এখনকার কথা ভিন্ন। আগের চেয়ে গাছ কমে গেছে। আর কেউ এখন এই পেশায়ও আসতে চায় না। আমার নিজের ছেলেই এখন অন্য কাজ করে। যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এই পেশা, এই সংস্কৃতি।

 

মানা যায় এই রসহীন শীত?

মাটির পাত্রে রস সংগ্রহ করা হতো। ছবি : সংগৃহীত

যশোরের বাসিন্দা আব্দুল করিম। বয়স ৩৫, সুঠাম দেহের অধিকারী। পেশায় একজন গাছী। তিনি বলেন, সারা বছর ব্যস্ততা না থাকলে শীতের এই সময়ে ব্যস্ততা একটু বেড়ে যায়। কেননা খেজুরের রসের চাহিদা এই সময়টাতে একটু বেড়ে যায়।

তিনি জানান, সাধারণত একটি খেজুর গাছের রসের উপযুক্ত হতে প্রায় ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। আর একটি গাছ থেকে রস পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত। তবে প্রতিটি গাছে কী পরিমাণ রস পাওয়া যাবে, তা নির্ভর করে গাছির দক্ষতা এবং গাছের ওপর।

তবে চাহিদা থাকলেও আয় তেমন নেই এই পেশায়। করিম বলেন, আগের চেয়ে গাছ অনেক কমে গেছে। এছাড়া সব কিছুর দাম বাড়লেও আমাদের খুব কম টাকা দেওয়া হয়। এই টাকায় পেট চলে না। এছাড়া সারাবছর বেকারই থাকতে হয়। তাই দিন দিন গাছীদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, গাছিদের অনাগ্রহ ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগুচ্ছে আমাদের এই সংস্কৃতি।

বাংলার শীতকালীন গ্রামের সকালে নতুন ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পিঠা পায়েস তৈরিতে খেজুরের রস ও গুড় যেনো এর অস্তিত্বের সাথে জুড়ে আছে।

মানা যায় এই রসহীন শীত?

গুড় বানানোর জন্য খেজুরের রস জ্বাল দেওয়া হয় । ছবি : সংগৃহীত

শীতের সকালে গাছিরা রস সংগ্রহ করে এলাকার বিভিন্ন স্থানে কিংবা হাটে-বাজারে (কাঁচা রস) খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে। এছাড়া কেউ কেউ সকালেই এই রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও গুড় তৈরি করার কাজ শুরু করেন। গ্রামের অনেক মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এই খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। যা দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক খাবার পায়েস ও হরেক রকমের পিঠা।

গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন আর আগের মতো এই রস পাওয়া যায় না। সারা গ্রাম খুঁজেও হঠাৎ দুই একটা খেজুরের গাছ বা গাছির সন্ধান পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে দু-একজনকে দেখা যায় গাছে হাড়ি বেধে দিয়ে রস সংগ্রহ করছে। তবে বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ায় তারাও এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। এই পেশাকে বিলুপ্তির পথ থেকে বাঁচাতে সবার এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন সাধারণ।

 

Advertisement
Share.

Leave A Reply