শুধুমাত্র বিশেষ দিনেই নয়, বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে উদযাপন করে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ, নানারূপে নানানভাবে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে মহীরূহের মতো,যার দর্শনের ছায়া মেলে ধরেছেন তার উপন্যাস, গল্প কবিতায়। আর সেগুলোই জীবনের বিভিন্ন বাঁকে উজ্জীবিত করে চলেছে একটা জাতিকে।
মনে পড়ে গেলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আমার প্রথম দর্শনের স্মৃতি। কোলকাতার এক বন্ধু ঋত্বিক একরকম জোর করেই বললো পুত্রদের নিয়ে জোড়াসাঁকো ঘুরে আসার জন্য। বললাম ওকে, ওরা ছোটমানুষ,ওদের কি ভালো লাগবে ঠাকুরবাড়িতে গেলে? ঋত্বিক বললো, যেয়েই দ্যাখোনা। ওরা অন্যরকম অনুভূতি আর স্মৃতি নিয়ে ফিরবে। হলোও তাই, ছেলেরা আমার এখন রবীন্দ্র ভক্ত।
হলুদ ট্যাক্সি থেকে নেমে যখন জোড়াসাঁকোর সদরদরজার দিকে পা বাড়ালাম, কী এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো আমি বোঝাতে পারবোনা। সামনেই ছোট একটা ভাষ্কর্য চোখে পড়লো, অপলক চেয়ে রইলাম..! ভেতরের দিকটায় উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনের চোখে দেখতে থাকলাম রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’র সেই বিভিন্ন চরিত্রগুলো।
অন্দরমহলে ঢুকে চলে গেলাম কবিগুরুর শয়নকক্ষে। আহা এই কক্ষে কতই না স্মৃতি বিজড়িত, মৃনালীনি দেবীর রান্নাঘরে ঢুকে যেন দেখছি রবীন্দ্রনাথ প্রিয়তমা স্ত্রীর গলা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলছেন তাঁর প্রিয় কোনো খাবারের পদ রেঁধে দেয়ার আবদার করছেন।
শুনেছি, অন্দরমহলে মৃনালীনি দেবীর রান্না বেশ জনপ্রিয় ছিলো, রবী ঠাকুর কম মশলাযুক্ত খাবার বেশি পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি প্রায়শই মাঝরাতে স্ত্রীকে জাগিয়ে তুলতেন তাঁকে প্রিয় কোনো খাবার রান্না করে খাওয়াতে। মৃনালীনি দেবীও নাকি স্বামীর সেই আবদার পূরণ করতেন বলে শোনা যায়।
তাঁর আতুড়ঘর, বারান্দায় তার অস্ত্রোপচারের ছোট একটা ডামি, তার আরাম কেদারা, সবই যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিলো ক্রমেই, আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম রবীন্দ্রযুগের স্মৃতিতে।
জোড়াসাঁকোর এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন তিনি, এখানেই কেটেছে তার শৈশব, যৌবন এবং পরবর্তীতে জীবনের অনেকটা সময় তিনি এখানে থেকেছেন। কবির মহাপ্রায়ণও হয়েছে এই বাড়িতেই।
ঠাকুরবাড়ির আানাচে কানাচে লেগে আছে রবিঠাকুরের স্পর্শ!
কবিগুরু তাঁর লেখনীতে স্পর্শ করেছেন মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র । প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ, মান- অভিমান, মানবতা, সকল ধর্মীয় গোঁড়ামী, হিংসা বিদ্বেষ,দেশপ্রেম.. সকল সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তার কলমের আঁচড়।
ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে তিনি লিখেছেন বহু আগেই, তার খুব ভালো প্রমাণ মেলে নিম্নের দুটি লাইনে…
‘ধর্মের বেশে, মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন,মারে আর শুধু মারে’
কবির লেখার সত্যতা আমরা হরহামেশাই দেখতে পাচ্ছি।
হিংসে বিদ্বেষ ভয়ানক খুব, মানুষ অন্ধ হয়ে যায় অহংকারে, কখনোই সোজা পথে চলতে পারেনা।
এ বিষয়ে কবিগুরুর আরো দুটি বিশেষ লাইন…
‘যারে তুমি নীচে ফেলো,সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছো যারে,সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’
প্রেম বিরহ কিংবা ভালোবাসা…কিইবা বলার আছে..এই বিষয়ে! প্রতিটি বাঙালি মেয়ের প্রথম প্রেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘ভালোবেস যদি সুখ নাহি..তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা’
কিংবা
‘হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়… হায় সজনী,উথলে নয়ন বারী’
আবার….‘সোহাগের সঙ্গে রাগ না মিশিলে ভালোবাসার স্বাদ থাকেনা…তরকারিতে লঙ্কামরিচের মতো’
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি অনেকটা উস্কে দেয় প্রেমময় অভিমানের অদ্ভুত সম্পর্ককে।
‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘খ্যাতির কলরবমূখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা রয়েছে, সেখানে স্থান নিতে আমার মন যায়না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে’।
শান্তিতে স্তব্ধতায় শায়িত তুমি কবিগুরু, আজ তোমার জন্মজয়ন্তীতে শতকোটি প্রণাম তোমায়।
লেখক : রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী