fbpx

সিফাত বিনতে ওয়াহিদের গল্প ‘রিংটোন’

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

সিফাত বিনতে ওয়াহিদের জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে। শৈশব কেটেছে ঢাকার মগবাজারে। বর্তমানে মাসিক পত্রিকা ‘প্রান্ত বার্তা’য় ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। প্রথম কবিতার বই প্রকাশ ২০১৬ সালে। নাম ‘পুনর্জন্ম’। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঘরের ভেতর ঘর নাই’। তার সর্বশেষ কবিতার বই ‘নিঃসঙ্গতায় আরো কিছু দেখা হোক’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। কবিতার পাশাপাশি শক্তিশালী গদ্য রচনাও তার নিত্য দিনের অভ্যাস। বিবিএস বাংলা’র পাঠকদের জন্য সিফাত বিনতে ওয়াহিদ লিখেছেন তার গল্প ‘রিংটোন’।

(ফোনে রিংটোন বাজছে: ‘পিপল আর স্ট্রেঞ্জ, হোয়েন আর ইউ স্ট্রেঞ্জার, ফেসেস লুক আগলি, হোয়েন ইউ আর অ্যালোন…’)

ভ্রু কুঁচকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট মুডে রাখলো আনিকা। তাচ্ছিল্যের সাথে আধ খোলা সিগারেটের প্যাকেট থেকে দাঁত দিয়ে কামড়ে সিগারেট উঠালো একটা। চোখেমুখে তখনও বিরক্তি। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে ইলেক্ট্রিক বাল্বের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নতুন একটা কবিতার কথা ভাবছিলো সে। ভাবছিলো বললে ভুল হবে। এতক্ষণ ভাবছিলো, ঘোড়ার ডিমের ফোনটাই মনের কানেকশনে ট্রাফিক জ্যাম লাগিয়ে দিলো। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে, কিন্তু কিছু মানুষের সেন্স এত ফালতু ধরনের, কেউ একবারের বেশি ফোন না ধরলে গাধার বাচ্চাগুলা বোঝার চেষ্টাও করে না যে তার ফোনটা ধরার চেয়ে জরুরি কাজ মানুষের থাকতে পারে- মনে মনে এসব হাবিজাবি ভাবনা ভিড় জমাচ্ছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে মগ্ন আছে আনিকা, মুহূর্তটাকে আজাইরা ফোন ধরে নষ্ট করতে চায় না।

ফোনটা এখনো বাজছে, সাউন্ড হচ্ছে না যদিও, তবুও আলোর জ্বলে জ্বলে নিভে যাওয়া চোখ এড়াচ্ছে না আদনানের। অনেকক্ষণ চুপচাপ ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে এই দৃশ্য দেখছিলো আদনান। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে স্বভাবসুলভ দুই আঙুলের টোকায় ফ্লোরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে আনিকার দিকে ঘুরে তাকালো। যদিও আনিকা আড়চোখে সবই দেখছে, তবুও সে এমন ভাব করছে যেন ওই মুহূর্তে ইলেকট্রিক বাল্বের দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর একটাও নেই পৃথিবীতে। আদনান মুচকি হাসছে, এবার আর এ দৃশ্য এড়ানো গেলো না, চোখ গিয়ে আটকে গেলো আদনানের চোখে। বিব্রতকর অবস্থা এড়ানোর জন্য চোখ নাচিয়ে ‘কী’ সূচক একটা জিজ্ঞাসা রাখলো আনিকা। আদনানের ঠোঁটে তখনও ঝুলছিল হাসিটা, মাথা ঝাঁকিয়ে ‘কিছু না’ টাইপ একটা উত্তর দিয়ে হালকা কাশলো। আনিকার চোখে তখনও কৌতুহল। ফোনের আলো জ্বলা বীরদর্পেই বলবৎ আছে। এবার আদনান ফোনের দিকে ইশারা দিয়ে বললো, ‘আপনার ফোনে কি একেকজনের জন্য একেক রিংটোন বাজে?’ আনিকা একটু অস্বস্তিতেই পড়লো এ প্রশ্নে। পৃথিবীতে এত প্রশ্ন থাকতে এই প্রশ্নই করতে হলো কেন? আনিকা বোকার মতো হেসে ফেললো, ‘নাহ! তা, না। এই আর কী…’

আদনান যেন আনিকার কোনো চুরি ধরে ফেলার মজা পেয়েছে, তেমন একটা রহস্যমাখা হাসি দিয়ে বললো, ‘কাল দেখলাম রোহান ফোন দিয়েছিল আপনাকে, তখন কিন্তু ডিফরেন্ট রিংটোন বাজছিলো, কী যেন…ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে, ‘কাম অন বেবি লাইট মাই ফায়ার’!’
এরচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে আনিকা কবে পড়েছে মনে করতে পারছে না। আদনান যদিও আনিকার অস্বস্তি ধরতে পেরেছে, কিন্তু এসব সিচুয়েশন ও খুব এনজয় করে।

আনিকা কথা খুঁজছিলো, কিন্তু কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আনিকার মধ্যে মানুষকে মুগ্ধ করার এক ধরনের প্রবণতা আছে। মনে মনে সে ভাবছিলো, আদনানকে কী বলে মুগ্ধ করা যায়। এরমধ্যেই আদনান আবার বলে ওঠলো, ‘আপনার রিংটোন নিয়ে কথা বলাতে কি বিব্রত হলেন?’ আনিকা খুব অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে জবাব দিলো, ‘ওমা! এতে বিব্রত হওয়ার কী আছে! শোনো ছেলে, অনি এত অল্পতেই বিব্রত হয় না।’ আদনান আবার হাসলো। ‘সেটাই! আই এপ্রিশিয়েট!’ আনিকার হার্টবিট এত জোরে ওঠা-নামা করছে যে মনে হচ্ছে আদনানের কান পর্যন্ত এই শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে। ইদানিং আনিকার এক রোগ হয়েছে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই তার কানে একটা না একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজতে থাকে। এই যেমন এখন বাজছে- ‘তুম দিল কি ধাড়কান ম্যায় রেহেতে হো রেহেতে হো’। মাঝেমাঝে এমন পরিস্থিতি হয় যে মাথার ভেতর চলমান ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা আনমনে হঠাৎ করেই গেয়ে ওঠে সে। এটা এক ধরনের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে তার।

কিছুদিন আগে এমন এক বাজে সিচুয়েশনে পড়তে হয়েছিলো আনিকাকে। রায়হানের সঙ্গে সেদিন খুব বাজে এক ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তার। গ্লোরিয়া জিন্সে বসে ধোঁয়া ওঠা কফি ঠাণ্ডা হতে চলছে, অথচ দুইজনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শেষ হওয়ার ফুসরত নেই। ঝগড়া শেষে চল্লিশ মিনিট দুইজন দুইদিকে মুখ ফিরিয়ে ফোনের ভেতর রাজ্যের ব্যস্ততা নিয়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে, অথচ ওই মোমেন্টে আদনান টেক্সট করলো, ‘আকাশের ভেতরের আকাশটাতে আজ বেশ মেঘ জমেছে, আসবেন নাকি? ছাদে বসে তারা দেখবো।’ টেক্সট আসার পর থেকে যে আনিকার মাথায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে, থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। ঠাণ্ডা কফি খাওয়ার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে রায়হান হুট করেই ওঠে দাঁড়ালো, গোমড়া মুখে জানতে চাইলো, ‘তুমি কি অফিসের দিকে যাবা? আই ক্যান ড্রপ ইউ, ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি আদার প্ল্যান!’ আনিকা কিছু না বলেই আদনানকে টেক্সট ব্যাক করতে করতে রায়হানের গাড়িতে ওঠে বসলো। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তখনো বাজছে। হুট করেই বলা নেই, কওয়া নেই, আনিকা গেয়ে ওঠলো, ‘উচি হ্যায় বিল্ডিং, লিফট তেরা বন্ধ হ্যায়, কেয়সে ম্যায় আউ, দিল রাজামান্দ হ্যায়…।’ আনিকার এই উদ্ভট আচরণে গুলশান এক নম্বর থেকে বনানী ব্রিজের দিকে গাড়ি টার্ন নিতে নিতে বেশ অবাক হয়েই তার দিকে তাকালো রায়হান। আনিকা বিষয়টা টের পেয়েও গেয়েই যাচ্ছিলো। ওই মুহূর্তে রায়হানকে এতটা পাত্তা দেওয়াটা ইম্পোর্টেন্ট মনে হয়নি তার। যদিও আহমাদ টাওয়ারের গেটে আনিকা যখন নেমে যাচ্ছিলো, রায়হান পেছন থেকে বলে ওঠলো- ‘তো? তোমার বাচ্চা প্রেমিকের ফ্ল্যাটটা বোধহয় একটু বেশিই উঁচুতে, লিফট ছাড়া ওঠতে মনে হয় তোমার বেশ কষ্ট হয়ে যায়!’

রায়হানের অহেতুক আলাপে কান দেওয়ার কোনো আগ্রহ নেই আনিকার৷ ফোনে তখন রিংটোন বাজছে- ‘হ্যালো, আই লাভ ইউ, য়োন্ট ইউ টেল মি ইয়্যুর নেম, হ্যালো আই লাভ ইউ, লেট মি জাম্প ইন ইয়্যুর গেম, শি’জ ওয়াকিং ডাউন দ্য স্ট্রিট, ব্লাইন্ড টু এভ্রি আই শি মিটস, হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো…’

Advertisement
Share.

Leave A Reply