রাজধানীর হাতিরঝিলকে ‘জনগণের সম্পত্তি’ ঘোষণা করে সেখানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং অন্যান্য সব ধরনের বানিজ্যিক স্থাপনা অবৈধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে হাতিরঝিল এলাকার সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত। এই নির্দেশনার পাশাপাশি রায়ে আরও ৯টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আজ ২৪ মে (মঙ্গলবার) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের স্বাক্ষরে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫৫ পৃষ্ঠার লিখিত পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় মোতাবেক রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি (Public Trust Property) তথা জনগণের জাতীয় সম্পত্তি।
এসময় হাতিরঝিলের ব্যবসায়িক স্থাপনা উচ্ছেদে জারি করা রুলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনোভাবেই ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না।
হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পে লে আউট প্ল্যানের নির্দেশনার বাইরে কতিপয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধে রাজউকের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রিট দায়ের করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ওই রিটের শুনানি নিয়ে পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই রুল যথাযথ ঘোষণা করে গত বছরের ৩০ জুন রায় দেন আদালত।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী রিপন বাড়ৈ ও সঞ্জয় মন্ডল। রাজউকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী ও আশেক মোমিন।
রায়ে বলা হয়, পানির প্রতিটি ফোটা অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ এ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং প্রতি ফোটা পানির দূষণ প্রতিরোধ একান্ত আবশ্যক।
হাইকোর্টের দেয়া পরামর্শসমূহের মধ্যে হাতিরঝিল এলাকায় পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরির পাশাপাশি পানির জন্য ক্ষতিকর লেকে এরকম সব যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে।
রায়ে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য ও জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে হাইকোর্টের দেওয়া ৪ দফা নির্দেশনা হলো-
* সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় মোতাবেক রাজধানী ঢাকার ফুসফুস খ্যাত বেগুনবাড়ী খালসহ খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি তথা জনগণের জাতীয় সম্পত্তি।
* হাতিরঝিল এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ এবং নির্মাণ সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদীর রায় অনুযায়ী বেআইনি ও অবৈধ।
* হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দকৃত সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে এসব বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো।
* এ রায়ের অনুলিপি প্রাপ্তির পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
এছাড়াও হাতিরঝিল বিষয়ে ৯ দফা সুপারিশসহ পরামর্শ দেন উচ্চ আদালত। এগুলো হলো-
১. হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিচালনার নিমিত্তে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ তথা হাতিরঝিল লেক সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি অধীন গঠন করা।
২. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ করা।
৩. জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিক মানের টয়লেট স্থাপন করা।
৪. নির্ধারিত দূরত্বে বিনামূল্যে সব জনসাধারণের জন্য পান করার পানির ব্যবস্থা করা।
৫. পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরি করা।
৬. পানির জন্য ক্ষতিকর হেতু লেকে সব ধরনের যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
৭. লেকে মাছের অভয়ারণ্য করা।
৮. হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা।
৯. হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয় রেভিনিউ (রাজস্ব) বাজেট থেকে বরাদ্দ করা।
