fbpx

১০ জানুয়ারি পূর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement
ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি-বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক অনন্য দিন। বাঙ্গালি মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফিরে পেয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দিনটি সেদিন থেকে বাঙ্গালি জাতির মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

জাতির পিতা নিজেই তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’(A Journey from darkness to light) হিসেবে। শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নতুন অভিযাত্রা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর পাকিস্থানী শাসক চক্র তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্থানে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস থাকতে হয়েছিল কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। এ সময় প্রতিমুহূর্তেই মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয় জাতির মহান নেতাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আগমন বাঙালি জাতির জন্য ছিল শ্রেষ্ঠ উপহার। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুযন্ত্রণা শেষে লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন। এর আগে পাকিস্তানের কারাগারে গোপনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল প্রকার আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্থানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী । বিশ্বের ৬৭টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে চিঠি দেন। অন্যদিকে তিনি নিজে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের ৫টি দেশ সফর করে বিশ্ব জনমত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। যার কারণে পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। বরং সস্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ লন্ডনে বিমানটি  অবতরণ করার পর ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা প্রথমে স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান যে,ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন।

সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’বলে সম্ভোধন করেণ।

বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙ্গালি হোটেল ঘিরে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে,বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করবে’।

বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে স্কটল্যান্ডে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর খবর শুনে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন, বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে বরণ করার জন্য।সেটা ছিল ব্রিটের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা।

৯ জানুয়ারী লন্ডন সময় তখন সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। স্বদেশে ফিরে আসার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করে নয়াদিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান।লন্ডন এবং নয়াদিল্লি উভয় জায়গাতেই তিনি পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিত্র ছিল এক রকমেরর আমেজ,সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে এক নজর মহান নেতাকে দেখার অপেক্ষায় ছিল লক্ষ লক্ষ জনতা।

বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারা বিবরণীতে বার বার ঘোষণা করা হচ্ছিল প্রিয় নেতার আগমনের প্রতিটি মুহুর্তের বর্ণনা। সে এক অন্যরকম উত্তেজনা, সবার চোখে আনন্দ্রাশ্রু। বাঙালির মহান নেতা আসছেন। লাখো মানুষের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’স্লোগান। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হল। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সদস্য,মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা বৃন্দগন,ছাত্র -জনতা সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে।

তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে লাখো জনতার ভালোবাসা সিক্ত হন। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মাত্র ৫ মিনিটের পথ পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা । সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য।  ১০ লক্ষেরও বেশি লোকের জনসমুদ্রে পরিনত হয় রেসকোর্স ময়দান।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যার প্রতিটি শব্দ ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশ গড়ার সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মত বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনে। দু’হাত তুলে সেই বক্তব্যকে সমর্থন করে দেশ গড়ার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ গ্রহন করে।

রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’

স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বলেছিলেন ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’।

তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন ‘আমি দেখায় দেবার চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’ বাংলাদেশের জনগন ১০ জানুয়ারিই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনও জানত না তাদের প্রিয় নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কিনা? তাই বিজয়ের মধ্যেও প্রতিটি বাঙ্গালির মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ।

এ ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে ১০ই জানুয়ারি ছিল বাঙ্গালির জন্য পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। সত্যিকার অর্থে ১০ ই জানুয়ারিতে বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে পেয়ে বাঙ্গালি বিজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করার সুযোগ পায়। এ দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয়।

লেখক: তাপস হালদার, সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা। ইমেইল:haldertapas80gmail.com

Advertisement
Share.

Leave A Reply