বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। এই মহীয়সী নারী যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখনকার সমাজ ছিল নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। কন্যা শিশুরা ছিল অনেকটা বোঝার মতো অবহেলিত। তখন তিনি সবার চোখে বুড়ো আঙুল দিয়ে নারী মুক্তির কথা তুলে ধরেন। শুরু করেন লেখালেখি। শুধু কাগজে নয়, নেমে আসেন পথে। সক্রিয় ছিলেন নারী মুক্তির প্রতিটি পদক্ষেপে।
পুরুষশাসিত সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও কুসংস্কারে জর্জরিত অশিক্ষা ও পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য নারীসমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেন এই মহীয়সী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর এই খ্যাতিমান বাঙালি নারী সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক ১৮৮০ সালের আজকের দিনে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আর ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরেই প্রয়াত হন। এজন্য এই ৯ ডিসেম্বরকে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
বেগম রোকেয়া তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ছিলেন পঞ্চম। তার পরিবার ছিল অনেকটা কট্টরপন্থী মুসলিম। পরিবারের সবাই উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনা বা বাড়ির বাইরে যাওয়া ছিল অনেকটা আকাশ কুসুম ভাবনা। কিন্ত তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবেন।
বোনের এই ইচ্ছা পূরণে পাশে এসে দাঁড়ান তার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের। ভাইয়ের ভরসায় রোকেয়া লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৮৯৬ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় খাঁন বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বিপত্নীক এবং এক কন্যা সন্তানের জনক। জীবনে যখন রোকেয়া স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেলেন, ঠিক তখন অনেকটা আশীর্বাদের মতো তার পাশে এসে দাঁড়ান স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। এরপর আর রোকেয়াকে পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি।
সাহিত্যে প্রথম তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘মতিচুর’ গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে। ১৯০৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এর ঠিক পরের বছর প্রকাশিত হয় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বা ‘সুলতানাস ড্রিম’ যা একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সালে তাঁর স্বামী জীবিত থাকাবস্থায়ই এটি বই আকারে বের হয়েছিল।
এই গ্রন্থ দুটিতে তিনি এমন এক সমাজ বিনির্মাণের কথা বলেন, যেখানে পুরুষ সমাজকে ঘরে আবদ্ধ করে সর্বত্র নারীরা বিচরণ করবে। নারীরা এখানে পুরুষের মুখাপেক্ষী হবে না। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত তারা পুরুষের ওপর নির্ভর করে নেবে না।
শুধু তাই নয়, বেগম রোকেয়া তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্যের কথাও তুলে ধরেন। তাঁর লেখনীতে তিনি বলেন, “কোনও শকটের (গাড়ির) দুটি চাকা যদি সমান না হয়, তাহলে সেই গাড়ি চলতে পারে না। অসমান চাকা নিয়ে গাড়িটি চালাতে গেলেই সেটি একই চক্রে শুধু ঘুরপাঁক খেতে থাকবে।”
তিনি সমাজের কাছে নিবেদন করেন এই সত্য যে, যদি সত্যিকার অর্থে আমরা সামনে এগুতে চাই, তাহলে, সর্বাগ্রে নারী-পুরুষকে সমানভাবে সক্ষম করতে হবে, এগিয়ে যাবার অনুকূল পরিবেশ দিতে হবে। তাছাড়া সমঅধিকারভিত্তিক প্রগতি অসম্ভব।
বেগম রোকেয়া নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমৃত্যু লড়ে যান। তিনি উপলব্ধি করেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন।
এই স্বপ্ন পূরণ করতে স্বামী সাখাওয়াত হোসেন তাঁকে দশ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তাঁর স্বামী মারা যান। মাত্র ২৯ বয়সে তিনি বিধবা হন।
স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ভাগলপুরে শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। কিন্ত সেক্ষেত্রেও তাকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাকে বাধ্য হয়ে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়। পরে ১৯১১ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুনভাবে স্কুলের যাত্রা করেন।
স্কুলটি ছিল ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানকারী প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। এই আটজন ছাত্রীর যাতায়াতের জন্য কলকাতার একজন ব্যবসায়ী প্রথম একটি ঘোড়ার গাড়ি উপহার দিলেন।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে জানলেও তিনি যে উঁচু মানের সমাজসংস্কারকও ছিলেন, তা অনেকের অজানা। ১৯১৭ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বিখ্যাত আলী ভাইদের মাবি আম্মা বেগম ও অ্যানি বেশানতের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে বেগম রোকেয়া তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে যোগ দেন। এ ছাড়া ১৯১৬ সালে কলকাতায় আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯১৭ সালে ওই সংগঠনের ৫০ জন মহিলা সদস্যের উপস্থিতিতে ১৫ এপ্রিল প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে একটা যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
সাহিত্য জীবনে তাঁর ৫টি বই প্রকাশিত হয়। ‘পদ্মরাগ’, ‘মতিচুর’ (দুই খণ্ড), ‘অবরোধবাসিনী’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’। মৃত্যুর পর বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপের একটি সংকলন বের হয়েছিল। আমৃত্যু তিনি লেখালেখি করেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর টেবিলে পেপারওয়েটের নিচে ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক একটি অর্ধসমাপ্ত লেখা পাওয়া গিয়েছিল।
তিনি জীবনে সবসময় একটা বিষয়ই বিশ্বাস করতেন। তাহলো -‘মেয়েমানুষ নয়, মানুষ হয়ে বাঁচতে হবে, তবেই সার্থক মানবজনমের।’ মুসলিম নারীর মুক্ত জীবন মানে অশালীনতা, উশৃঙ্খলা নয়- এ সত্য সমাজকে বোঝাতে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
বেগম রোকেয়ার সমাজ থেকে এত বছর পরে নারী জীবনের মুক্তি ঘটেনি। থেমে নারীর ওপর নিপীড়ন এতোটুকু। তাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী বদলাতে আজও বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক।