সোমেশ্বর অলি। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ২০ বছর। কবিতার তাড়নায় ঘর ছেড়েছিলেন, আর ফেরা হয়নি। এখনও কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করেননি। লিখছেন নিরন্তর, কবিতা ও লিরিক। প্রায় এক যুগের সাংবাদিকতায় ইতি টেনেছেন। চাকরিসুবাদে এখন কাজ করছেন ই-বুক নিয়ে।
আব্বা আমার লেখালেখিকে খুব বেশি প্রশ্রয় দিতেন না। এটা একেবারে শুরুর দিকের কথা, যখন স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া হয় নি, লেখার জাবর কাটি বা লিখি ছড়া বা হাবিজাবি। ২০০৪ সালে আব্বা জানলেন যে, তাঁর ছোট ছেলেটি লেখালেখির সুবাদে একটা ক্রেস্ট (যুগান্তর স্বজন সমাবেশ সেরা লেখক পুরস্কার ২০০৪) পেয়েছে, সেই ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, চাক্ষুশ হলেন; এরপর, অনুমান করি, যখন নিয়মিত লেখা প্রকাশ হচ্ছে জাতীয় দৈনিকে বা অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়, তিনি কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করেন আমার ব্যাপারে।
আব্বার ধ্যান-জ্ঞান, জীবনাচার ছিল ইসলামকেন্দ্রিক। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, এমনকি প্রতিটি নি:শ্বাসকে তিনি ইবাদতের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজের এমন আদর্শেই গড়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর সন্তানদের। এ ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা অসফল।
কৃষিপ্রধান পরিবারে বেড়ে উঠতে উঠতে বুঝতে পারতাম, আব্বাও অভয় দিতেন, তাঁর যতখানি সহায়-সম্পদ, তাতে করে আমাদের চাকরি করা লাগবে না। তিনি চাইতেন না তাঁর সন্তানরা ‘চাকর’ হোক। দ্রুতই তাঁর এমন ’দুরদর্শী চিন্তা’য় ব্যাঘাত ঘটলো। কৃষিব্যবস্থা ভেঙে যেতে শুরু করলো, কমতে শুরু করলো ধানের ফলন, বিরাট সংসারে বাড়লো তাঁর বয়স আর খরচাদি এবং পারিবারিক সংকট-জটিলতা। অদূরদর্শী আমি, যে কি-না বাজারভর্তি একটা থলে নিয়ে ঠিকঠাক ঘরে ফিরতে আলসেমি ও ইতস্ততবোধ করতো কিংবা ছোটখাট ফুটফরমাশগুলো গায়ে মাখতো না, সে, পরিবারকে পাশ কেটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের পথ নিজেই বেছে নেবে বলে…!
আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে- কিছু মুগ্ধতা আর মুখরতার সামনে, পাশেই বিপুল ব্যর্থতার এক পাহাড়; যাকে অগ্রাহ্য করেই আমার সিনা টানটান, লক্ষ্য অটুট।
আব্বা দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন সম্মান নিয়ে ইহকাল কাটানোর এক সহজ-সুন্দর জীবনতরিকা। আজ নিজের দিকে তাকালে মনে হয়, কী কঠিন, দুর্বিষহ আর কূটকৌশলের এক জীবন বেছে নিয়েছি!
আজ ৯ বছর, শারীরিকভাবে আব্বা নেই। কিন্তু আব্বা আছেন, বহুরূপে বহুভাবে। এমনকি আম্মার না-থাকার মাঝখানেও আব্বা আছেন বিপুল প্রতাপের সঙ্গে।