আল মারুফ রাসেল। জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৩ নভেম্বরে পুরনো ঢাকায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলাবাগানে। পড়াশোনা প্রত্নতত্ত্ব ও আলোকচিত্র নিয়ে। সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালে সমকাল পত্রিকায়। পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন সুন্দরবন বাঘ প্রকল্প ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার অ্যাণ্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন)-এ। তিনি ‘দ্য বঙ্গ প্রজেক্ট’ নামে একটি ইতিহাস গবেষণা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে ‘হেরিটেজ ওয়াক ঢাকা’ সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত। বিবিএস বাংলা’র পাঠকদের জন্য আল মারুফ রাসেল নিয়মিত লিখছেন তার শহরের ইতিহাসের বাঁক বদলের নানা পর্ব নিয়ে।
ঢাকার চারশ বছর পূর্তি নিয়ে এই একযুগ আগে অনেক হৈ চৈ হয়। আয়োজিত হয়েছিলো নানা ধরনের সরকারি অনুষ্ঠান। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস বরাবরই রাজা-রাজড়াদের ব্যাপার। আমার মত আদার ব্যাপারির তাতে বিন্দুমাত্র কৌতুহল জাগেনি। ঢাকার মাটির বয়স কি এতটাই কম? এই ঢাকায় অরণ্যচারী আদিবাসী বা কৃষিজীবি নিষাদেরা কি ছিল না কোনোকালে?
ঢাকার লালমাটির এলাকাগুলো তো বহু প্রাচীন। সেখানে কোনও সভ্যতা বা লোকালয় কি গড়ে ওঠেনি কোনোকালে? বরাবর সন্দেহপ্রবণ ‘আমি’ সংসদ ভবনে আতশবাজি দেখতে গিয়েছিলাম- আমার ‘রাজধানী ঢাকা’র চারশ বছর উদযাপন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ।
রাজধানী শহর হওয়ার আগেও যে ঢাকা এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, তা অস্বীকার করার সাহস এখনকার লোকেরা দেখালেও আমি সেকেলে মানুষ। রূপকথার গল্পের মত অনেক অনেক দিন আগের কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! শহরের লালমাটির এলাকায় গেলেই হারিয়ে যাওয়া শালবনের জন্য কাতর হই। প্রকৃতির সন্তান সেই সব বুনো পশু, পাখিদের কথা ভাবি, যারা এককালে দাপিয়ে বেড়াত ঢাকার জঙ্গল। ভাবি কোনও এক অরণ্যচারী ভেড্ডিডের কথা, যে তার বিষ মাখানো তীর নিয়ে লক্ষ্যভেদের অপেক্ষায়।
ঢাকা যে মুঘল রাজধানীরও আগেকার জনপদ তার প্রমাণের অভাব নেই। তবে আজকে যে প্রমাণ হাজির করতে চলেছি, সেটা কেবল প্রাচীন জনপদ হিসেবেই ঢাকাকে তুলে ধরে না একই সঙ্গে ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিতি দেয়। ঢাকার ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মূলত দুটো দলে ভাগ করা যায়, একটা দল মনে করেন মুঘলদের আগে ঢাকার কোন গৌরবজনক অধ্যায় নেই। মুঘলরা বাংলায় এসে ঢাকাকে ‘জাতে’ তুলেছেন। আরেকদল মনে করেন, ঢাকার নগরায়নের ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। বলাই বাহুল্য আমি দ্বিতীয় দলের লোকেদের অনুসারী। এই দলে পাওয়া যাবে ঢাকার স্কুল পরিদর্শক ও বাংলা ও আসাম ধাতবমুদ্রা কমিটির সচিব এইচ ই স্টেপলটন, ঢাকা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী, বাংলা ও ঢাকা নিয়ে কাজ করা পাকিস্তানি প্রত্নতত্ত্ববিদ আহমাদ হাসান দানি (ঢাকা জাদুঘরের অগ্রযাত্রায় ও ঢাকায় পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পিছে যার অবদান অপরিসীম) আর বাংলাদেশের প্রত্নচর্চার অগ্রপথিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াকে।
আজকের গল্প শুধু স্টেপলটনকে নিয়ে, যিনি ১৯১১ সালের এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে লিখেছিলেন ঢাকায় পাওয়া স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে, যা ঢাকার ইতিহাসকে এক ধাক্কায় আরও এক হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে যায়।
নিচে এইচ ই সেটপলটনের গল্পটাই দেয়া হল, তৃতীয় পুরুষে।
ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে পিলখানা, খেদা বিভাগের সদর দফতর, আর ঠিক তার পেছনে বিস্তৃর্ণ কৃষিজমি, যা এখন ছোট ছোট মাঠে বিভক্ত- ‘নবাব রশিদ খান কা বাগিচা’ নামে পরিচিত। এই রশিদ খানকে ১৬৬২ সালে আওরঙ্গজেব কামরূপের ফৌজদার করে পাঠান। তিন চার বছর অনিচ্ছার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করে ইস্তফা দেন তিনি। ১৬৬৯ সালে তিনি রাজা রাম সিংহের সঙ্গে আসামিদের থেকে গোহাটি উদ্ধার অভিযানে যোগ দিলেও,মাঝপথে ঝগড়া করে বেরিয়ে যান। তার নাম শেষবারের মত দেখা যায় ‘মাসির-ই-আলমগিরি’ বইয়ে, ১৬৭৯ সালে গোহাটি জয়ের অভিযানের ব্যয়ের হিসেবে। তার নবাবি লাভের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে হতে পারে তিনি সুবাদার মুহাম্মাদ আযমের সঙ্গে এই গোহাটি অভিযানের সময় তা বাগিয়ে নিয়েছিলেন। সে যাই হোক, রশিদ খানের বাগানের সঙ্গে পিলখানার রাস্তার লাগোয়া দক্ষিণ পাশে একটি পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের থেকে পশ্চিম দিকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তিন বছর আগে একটি মুদ্রা পাওয়া কুড়িয়ে পেয়েছিল পিলখানার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে বয়ে যাওয়া নদীর ধারের মনেশ্বর গ্রামের মুন্সী আকবরের এক রায়ত, জমাদার আলীর ছেলে। জমাদার আলীর আরেক ছেলের কাছে জানতে চাইলে বলেন, এটা আসলে সোনার টাকা নাকি পিতলের টুকরো তা জানতে এলাকার তালুকদার ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনোহর দের কাছে নিয়ে গেলে তিনি এটাকে স্বর্ণমুদ্রা বলে ৮ রূপির বিনিময়ে কিনে নেন। পরে ১৯১০ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু মোহিনী মোহন বসু এই স্বর্ণমুদ্রাটি দেখতে গেলে তাকে জানানো হয় যে, পাশের পোদ্দারদের কাছে এমন আরও কয়েকটি রয়েছে, যা তিনি চাইলেই সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন,সম্ভব হলে তিনিও একটি সংগ্রহে রাখতে চান। এর কিছুদিন পরই তিনি ৯ টাকার বিনিময়ে একটি স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করেন। প্রথম স্বর্ণমুদ্রাটি রশিদ খানের পুকুরের কাছে পাওয়া গিয়েছিল এটা নিশ্চিত। গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসা করেও জানা গিয়েছে তারা এই স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে পাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানত। আর পোদ্দারও যে প্রধান শিক্ষকের কাছে আরেকটি স্বর্ণমুদ্রা বিক্রি করেছে আর তাকে জানিয়েছে যে সে আরও একটি সংগ্রহ করেছে গোলাম নবী নামের এক নেওয়ারি বা পুরনো স্বর্ণের দালালের কাছ থেকে। গোলাম নবীকে পাওয়া যায়নি, কারণ সে তার ব্যবসার কাজেই ঢাকার বাইরে থাকত বেশি। তবে পোদ্দার নিশ্চিত করেছিলেন যে, গোলাম নবীর সংগ্রহে এমন আরও অনেক স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে।
প্রথম মুদ্রাটি সোনার (দেখে মনে হয় ঢালাই করে তৈরি) ওজন ৮৭.৬ গ্রেইন, আকার .৮০ ইঞ্চি। এর একদিকে গুপ্ত রাজা, ডানদিকে তাকিয়ে, বাম হাতে ধনুক, আর ডান হাত গরুড়ের ধ্বজার উপর দিয়ে একটি তীর ধরে আছে। মুদ্রায় আঁকা মানুষের আকৃতি অনেকটা ভিনসেন্ট স্মিথের ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম ক্যাটালগ অফ গুপ্তা কয়েনস এ বর্ণিত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রার মতো। আর ধনুকটা একই লেখকের ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বর্ণিত সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রার ধনুকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ঢাকায় প্রাপ্ত এই মুদ্রায় রাজার মাথা ঘিরে কোনও জ্যোতির্বলয় নেই, বা জমিনে কোন বর্ণ নেই, মুদ্রার প্রান্ত জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিন্দু দিয়ে সীমানা দেয়া। মুদ্রার প্রান্ত মুড়ে দেয়া হয়েছে পরে। বিপরীত দিকে বৃত্তাকার বিন্দুর সমষ্টির ভেতরে রাণী বা দেবী দাঁড়ানো, দৃষ্টি বাম দিকে। তার পেছনে উড়ন্ত চুল, আর সামনে গুপ্ত বর্ণের সমষ্টির নির্দেশ করে।
চোখে দেখে ও ওজন করে (আধা তোলা) প্রথমে স্টেপলটনের মনে হয়েছিল এই মুদ্রা নকল। যদিও ধনুক এতটাই পরিষ্কার যে অবশ্যই আসল গুপ্ত মুদ্রা দেখেই সেটি বানানো বলে মনে হয়। সবমিলিয়ে এই ধরনের মুদ্রার আবিষ্কার নতুন ছিল, এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের বিশেষত বিপরীত দিকের বর্ণনার মত গুপ্ত মুদ্রা নিয়ে আগে কোথাও আলোচনা হয়নি। কিন্তু প্রায় একই রকম একটি মুদ্রার ছাপ স্টেপলটনের হাতে এসে পড়ে যেটা কোটালিপাড়ার এক রায়তের সংগ্রহে ছিল। এবারে এটি পাঠিয়েছিলেন ১৯১০ সালে ফরিদপুরের সহকারী সেটলমেন্ট অফিসার বাবু কালীপদ মৈত্র। এই মুদ্রার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কেনার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই মুদ্রাগুলো স্কন্ধগুপ্তের অনেকগুলো মুদ্রার সঙ্গেই পাওয়া গিয়েছিল, আর রাজার আকৃতিও সেখানে একই রকম, তাই স্টেপলটন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে এগুলো স্কন্ধগুপ্তেরই জারি করা নতুন ধরনের মুদ্রা। অবশ্য পরে তিনি যোগ করেছেন, ৩০ জানুয়ারি ১৯১০ তারিখে কোটালিপাড়ায় গিয়ে প্রথম মুদ্রার মত আরও তিনটি মুদ্রা সেখানে খুঁজে পান।তিনি এরপর সিদ্ধান্তে আসেন যে এগুলো স্কন্ধগুপ্তের আরও পরে জারি করা বাংলা মুদ্রা। একটি মুদ্রায় তিনি বাংলা বর্ণ (সংস্কৃত!?)‘ম’ খুঁজে পেয়েছিলেন।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় মুদ্রার ক্ষেত্রে। এটিও স্বর্ণমুদ্রা (সম্ভবত ছাঁচে চাপ প্রয়োগ করে তৈরি)। ওজন ৮৮.৩ গ্রেইন। আকার .৮৮ ইঞ্চি। মুদ্রার উপরের দিকটা প্রথম মুদ্রার মতই, কেবল বেদির সামনে একটি ঘোড়া দাঁড়ানো রয়েছে, রাজার বাম হাতের নিচে। রাজা ও গরুড়ের মাথার মাঝখানে একটি ধ্বজায় শ্রী লেখা রয়েছে গুপ্ত বর্ণে। আর ধনুকটাও খানিকটা ছোট, প্রথম মুদ্রার তুলনায়।
মুদ্রার বিপরীত দিকটাও প্রথম মুদ্রার মতই। এতে আরও ডিটেইল রয়েছে। মুদ্রার প্রান্তগুলো যন্ত্র দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ছাঁচে পিষ্ট হওয়ার পর। পেছনের দিকে একটি বিন্দু রয়েছে, যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামনের দিকটায় একটি খাঁজও রাখা হয়েছে। দুটো মুদ্রাতেই বিপরীত দিকের নকশা ৯০ ডিগ্রিতে অবস্থিত।
এই দ্বিতীয় স্বর্ণমুদ্রা প্রথম স্বর্ণমুদ্রার মতই কোনও একটি মুদ্রা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বানানো। এটা এই কারণে আরও চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে যে, এই স্বর্ণমুদ্রা অশ্বমেধ যজ্ঞের আরও একটি মুদ্রার সিরিজের অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। যদি প্রথম মুদ্রাটি স্কন্ধগুপ্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে এটা প্রথম কুমারগুপ্তের অশ্বমেধ যজ্ঞের স্মারক মুদ্রা থেকে অনুপ্রাণিত নিঃসন্দেহে, কারণ সেখানেও কুমারগুপ্তের সন্তান স্কন্ধগুপ্তের উপস্থিতি ছিল বলেই জানা যায়।
এই মুদ্রাগুলো আসল হলে, প্রথম মুদ্রার আবিষ্কারের জন্য কোনও ধরনের তত্ত্ব দাঁড় করানো মুশকিল, কেবল ধারণা করা যেতে পারে ঢাকার আশেপাশে আসল গুপ্ত মুদ্রা দেখে এই ধরনের মুদ্রা তৈরি করা হত। নেওয়ারির সঙ্গে কোনওরকম দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায় এটা বলাও মুশকিল যে পোদ্দারের কাছে যাওয়া মুদ্রাটি ঢাকার ছিল কি না বা ঢাকা থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল কি না। আবার এমনটাও হতে পারে যে, কোটালিপাড়ার মত গুপ্ত মুদ্রার প্রচলন অন্য রাজারাও করেছিলেন, যেমনটা যশোরের উত্তর-পূর্বের মুহাম্মাদপুরে আবিষ্কৃত হয়েছে। কারণ সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় তিনি সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর- সমতট, দাভাকা, কামরুপ ও নেপালের উপরেও তার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ভিনসেন্ট স্মিথ দাভাকাকে এখনকার রাজশাহী বিভাগে ফেলেছেন,কিন্তু তার বক্তব্যে মনে হয় তিনি একশ বছর আগেকার (১৮১৩!) ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ এড়িয়ে গিয়েছেন, কারণ সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল আর পাবনা ও বগুড়ার সঙ্গে ঢাকার কোনও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এ কারণে ধারণা করা যেতে পারে দাভাকা অবস্থিত ছিল ব্রহ্মপুত্র গারো পাহাড়ের কাছে যেখানে সেটা বাঁক নিয়ে দক্ষিণ শাহবাজপুরে মেঘনা-গঙ্গার পুরনো সঙ্গমস্থলে মিশেছে আর গৌড় থেকে এসে একই জায়গায় মেশা গঙ্গার সঙ্গমস্থলের মধ্যবর্তী জায়গায়। যদি ভিনসেন্ট স্মিথের চিহ্নিত করা উজ্জয়নের বিক্রমাদিত্যই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত হয়ে থাকেন, ঢাকার ঠিক পাশের বিক্রমপুর তাহলে তার নামেই, যিনি দিল্লিতে লোহার স্তম্ভলেখ তৈরি করিয়েছিলেন আর সেখানে লেখা রয়েছে তিনি বঙ্গীয় দেশগুলোতেও লড়াই করেছিলেন। স্টেপলটন অবশ্য ভিনসেন্ট স্মিথের তৈরি করা বঙ্গের মানচিত্র আরেকটু ঘষামাজা করতে বলেছিলেন, কারণ বঙ্গের সীমানা বহুকাল ধরেই পশ্চিমে করতোয়া. দক্ষিণে গঙ্গা, পূবে মেঘনা আর উত্তরে গারো পাহাড়। এমনকি স্টেপলটন একটু আগ বাড়িয়ে বলেই দিয়েছেন সম্ভবত বঙ্গের আরেক নাম ছিল দাভাকা।
এই মুদ্রা নিয়ে স্টেপলটনের বক্তব্য এখানেই গিয়ে থেমেছে। এখন ভেবে দেখা প্রয়োজন, দাভাকা থেকে ঢাকা হওয়াটা খুব বেশি অবাস্তব নয়!
এই মুদ্রা দেখার খায়েশ হয়েছিল এককালে। তাই একটু খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছিলাম, কোথায় আছে তারা। এই খোঁজ করতে গিয়ে আরও এক চোট পড়াশোনা করতে হলো।
আহমাদ হাসান দানি বলেই দিয়েছেন, এই মুদ্রাগুলো গুপ্ত অনুকৃতি স্বর্ণমুদ্রা বলে। আর সময়কাল- সপ্তম শতাব্দী। আরও একটু ঘাটতেই পেলাম এই মুদ্রা নিয়ে বিশিষ্ট মুদ্রাতত্ত্ববিদ ড শরিফুল ইসলামের লেখা। তিনি বলেছেন, ‘পিলখানার মুদ্রা ‘গুপ্ত-কুষাণ অনুকৃতি মুদ্রা’। গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের পর খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমভাগে বঙ্গ-সমতট অঞ্চলে এক ধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল, যার এক পিঠ ছিল গুপ্ত আমলের মুদ্রার অনুকৃতি এবং অপর পিঠে ছিল কুষান আমলের মুদ্রার অনুকৃতি। তিনি আরও জানান, এক পিঠে গুপ্ত ও এক পিঠ কুষান মুদ্রার অনুরূপ লেখাবিহীন এই মুদ্রা নিয়ে আগে বিভ্রান্তি ছিল। এ ধরনের মুদ্রাকে সম্প্রতি একাডেমিক মহলে গুপ্ত-কুষান অনুকৃতি মুদ্রা বলা হচ্ছে। ড শরিফুল ইসলাম বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উপপরিচালক, সেই হিসেবে তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে এ ধরনের অর্ধশতাধিক মুদ্রা সংগৃহীত হয়েছে জাদুঘরে।
এছাড়াও জানা গেল, ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রনয়ণ কমিটিও নাকি ঢাকার পুরনো নিদর্শন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঢাকা জাদুঘর তৈরির আগে এই এলাকা থেকে পাওয়া সব নিদর্শন হয় বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, নয়তো এখনকার কলকাতার কয়েকটি জাদুঘরে ঠাঁই পেত। সেখানেও নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি এইসব মুদ্রা। তারপরও শোনা কথায় কান না দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা ও ভারতীয় জাদুঘরে ঢুঁ মেরেছি। লাভের ভেতরে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে, চা খাওয়া হয়েছে, অন্য অনেক কিছুর সন্ধানও মিলেছে, কেবল ধরা দেয়নি এই মুদ্রাগুলো। হয়ত সদাবি বা বড় কোনও নিলাম ঘরে উঠে তা শোভা পাচ্ছে কোনও ধনকুবেরের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। হতে পারে দেশেরই বা ভারতের কোনও জাদুঘরের গোডাউনে বাক্সবন্দি তারা, ঢাকার ১৪০০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে।