Advertisement
আফসানা কিশোয়ারের জন্ম ১৯৭৮ সালের ৮ মার্চ ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হন। তিনি আশৈশব লেখালেখিতে সক্রিয়। ২০০০ সাল থেকেই দেশের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে তাঁর লেখা প্রকাশ হতো। এ সক্রিয়তার স্বীকৃতিও আসে। দৈনিক প্রথম আলো’র সেরা ফিচার লেখকের পুরস্কার জয় করেন এ কীর্তিমান। সৃষ্টিশীল সত্বা আফসানা কিশোয়ার একাধারে কবি, লেখক, কলামনিস্ট ও অ্যাকটেভিস্ট। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কলাম মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। পাঠক প্রিয় এই লেখক এবারের বইমেলায় প্রকাশিত আফরোজা সোমা’র প্রবন্ধের বই ‘বেশ্যা ও বিদূষীর গল্প’ এর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন বিবিএস বাংলা’য়।
টেলিভিশনগুলোতে বছরের পর বছর দৈনিক যত বিজ্ঞাপন প্রচার হয়, তার সিংহভাগের বার্তা হচ্ছে : নারীর মূল কাজ রান্না করা ও ঘর সামলানো। গণমাধ্যমে নারীর এই ছাঁচে বাধা উপস্থাপন নিয়ে কোথাও আলাপ বা বাদ-প্রতিবাদ নেই। অথচ ওয়াজের নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের চেয়ে এই বিজ্ঞাপনগুলোর প্রভাব জনমানসে কোনো অংশেই কম নয়। নিরীহ উপস্থাপনের আড়ালে এগুলো আদতে স্লো পয়জনিং।
এভাবেই আফরোজা সোমা তাঁর এই বইমেলায় প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বেশ্যা ও বিদূষীর গল্প’ তে আমাদের অন্যভাবে চিন্তার এক কৌণিক দিকে আলোকপাত করেন তাঁর লেখা দিয়ে।
সমাজে ধনী ও গরীবের যে অবস্থান তাকে যদি আশরাফ ও আতরাফ হিসেবে বিন্যস্ত করা হয় তবে সেই গরীবের ভেতর তস্য গরীব হচ্ছে নারী। নারীর অবস্থানগত নানা দিক, তার আয়ুযাপনের বিবিধ সমস্যা, তার নিজের পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে যে অন্ত্যজ অচ্ছুতের নিম্নগামী মর্যাদা তা আমরা পলে পলে অনুভব করি অক্ষরের বিন্যাসে সোমার রচনায়।
পুরো বিশ্বের মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও নারী-পুরুষের এই বৈষম্য প্রকট। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, এই অঞ্চলে গত পনেরো বছর ধরে যে হারে অগ্রগতি হয়েছে, যদি এই উন্নতির ধারা বজায় থাকে তাহলেও নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করতে সময় লাগবে একাত্তর বছর। বাংলাদেশে এখনও ব্র্যাকের তথ্যমতে, গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন।
নারীকে হেয় করা, তাকে যাপিত জীবনে নানা অনুষঙ্গে জর্জরিত করা যেন কিশোরের ব্যাঙের গায়ে ঢিল ছোড়ার মতো নির্দোষ(!) খেলা। নারীবিদ্বেষী ভাবনা কৌতুকের মধ্য দিয়ে ছড়ায় এবং সেটি নারীর বিরুদ্ধে সমাজে জারি থাকা বিদ্বেষ ও বৈষম্যকে আরও জোরদার করে।
এমন ভাবনার সংস্কার তাহলে কীভাবে সম্ভব? এক্ষেত্রে লেখক আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ ও এসিড সন্ত্রাস রোধে দীর্ঘমেয়াদী অ্যাডভোকেসির যে কার্যক্রম তাকে উদাহরণস্বরূপ কোট করেন এবং বলেন ইচ্ছে দৃঢ় হলে বহু প্রাচীন সামাজিক ধারণাও পাল্টানো সম্ভব।
সংখ্যালঘু কি মানুষ শুধু ধর্মীয় মাপকাঠি বা জাতিগত ভিন্নতার কারণে হয়? হয় না। আগুনে পুড়িয়ে মারা নুসরাতকে দেখুন। ধর্মীয় বিবেচনায় গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সদস্য হলেও লিঙ্গীয় বিবেচনায় সে লঘুদশার শিকার। সংখ্যালঘু একটি দশা। এই দশা একদিনে তৈরি হয় না। দিনে দিনে ক্ষমতার অপব্যবহারে, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণে এই দশা ঘণীভূত হয়।
নিজের দেহের উপরও কোনো অধিকার নেই কার? নারীর। হোমোস্যাপিয়েন্সের বায়োলজিক্যাল জার্নি বজায় রাখার জন্য দাসের মতো ব্যবহার করা হয় কাকে? নারীকে। পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, আচরণ, যূথবদ্ধতা, কর্ম, উদ্বাস্তু – সবক্ষেত্রে নিয়ম কার জন্য প্রযোজ্য? নারীর জন্য। যৌন নিগ্রহ হলে, ধর্ষণ হলে, হত্যা হলে কাকে ভিকটিম করা হয়? নারীকে। কার কোনো সাফল্যই ইতিহাস ধারণ করে না? নারীর।
নারীকে উপজীব্য করে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে বহমান নানা অসঙ্গতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আলোচনা জারি রাখার সত্য ও আন্তরিক প্রয়াস আমরা দেখতে পাই আফরোজা সোমা’র এই গ্রন্থে।
হাসান’স থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য চারশ টাকা। এবারের বইমেলায় বইটির পরিবেশক পেন্ডুলাম।
ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে লেখকের সাথে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে আমাদের পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। লেখক ও আমি একমত হই যে, প্রজন্ম নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রজন্মের চোখে চলমান সমস্যা ধরিয়ে দিলে, সমাধান ও একযোগে কাজ করলে ফল আসবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে এ গ্রন্থের প্রকাশ একটি সহজিয়া পাঠের কাজ করবে বলে আমি মনে করি।
Advertisement