দেশের অধিকাংশ বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ইচ্ছে মাফিক ফি আদায় করা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না সরকারি নির্দেশনাও। বছরের শুরুতেই তাই বাড়তি খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) জানিয়েছেন, ভর্তি ফি আদায়ের ক্ষেত্রে কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাড়তি ফি আদায় করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সর্বশেষ জারি করা নীতিমালায় অন্তত ৭ খাতে ফি নিতে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো মানছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ আছে আরো।
জানা গেছে, মাউশি’র নির্দেশনা না মেনে লটারির পরিবর্তে পরীক্ষার আয়োজন এবং অর্থ পরিশোধ না করলে বই দেওয়া হচ্ছে না – এমনটা ঘটছে অনেক স্কুলে।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এবার ভর্তির ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে পরীক্ষা ছাড়া লটারিতে সম্পন্ন করতে হবে। আর প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা নিচের ক্লাস থেকে পরের ক্লাসে পদোন্নতি পাবেন পরীক্ষা ছাড়াই। এছাড়া করোনা পরিস্থিতির কারণে কোন খাতে ফি নেওয়া যাবে আর কোন খাতে নেওয়া যাবে না, সেই বিষয়ে আলাদা নির্দেশনা আছে। ভর্তি ফি এবং পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেওয়া নির্দেশনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ না পেয়ে থাকলে মাউশির ওয়েবসাইট থেকে নিতে পারবে। কিন্তু পাইনি এমন কথা বলে সরকারি নির্দেশনার বাইরে কাজ করা যাবে না।’
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকার বাইরে দক্ষিণবঙ্গের পটুয়াখালীর বাউফলের বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোদ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাউশির নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফি কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক’জন অভিভাবক বলেন, যেসব খাতে অর্থ আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সরকারের নিষেধাজ্ঞাকৃত খাতও আছে। শিক্ষকদের ডেকে বৈঠক করে এ কর্মকর্তা ১১টি প্রধান খাত নির্ধারণ করে দেন। এগুলো হচ্ছে-পুনঃভর্তি, সেশন চার্জ, আইসিটি, উন্নয়ন/মেরামত, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক, আবেদন ফরম, বিদ্যুৎ। এছাড়া বোর্ড নির্ধারিত কয়েকটি খাত আছে। অন্যদিকে সেশন চার্জের মধ্যে আছে ভর্তি ফি, কন্ট্রিবিউশন, আন্তঃক্রীড়া, লাইব্রেরি, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন, জাতীয় দিবস, রসিদ বই ও দরিদ্র তহবিল। এসব খাত মিলিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২৬২০ টাকা, সপ্তম শ্রেণিতে ২৭২০, অষ্টম শ্রেণিতে ৩০২০, নবম শ্রেণিতে ৩২২০ এবং দশম শ্রেণিতে ৩৫২০ টাকা সেশন ফি নির্ধারণ করা হয়। তবে এখন ভর্তিকালে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। সাধারণত নির্ধারিত সব ধরনের ফি একবারে আদায় করা হয় না। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা যা পরিশোধ করে তার অবশিষ্টটা বকেয়া হিসেবে থাকে। অর্ধবার্ষিক আর বার্ষিক পরীক্ষাকালে বাকিটা আদায় করা হয়।
প্রায় একই ধরনের চাতুর্য দেখিয়েছে ঢাকার ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি দুই ভাগে অর্থ আদায় করছে। এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে এখন ২৬শ করে টাকা পরিশোধ করতে বলেছে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরিশোধ করতে হবে ৮ হাজার ৬০০ টাকা। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একই সময়ে ৮ হাজার আর নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৯ হাজার ৫০০ টাকা জমা দিতে হবে। এর মধ্যে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১৪ জানুয়ারির মধ্যে ২৮শ আর নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩ হাজার টাকা জমা দিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে বিভিন্ন ধরনের কৌশল নিয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। তারা বলছেন, সরকার ফি নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলো মানছে না। সন্তান লেখাপড়া করায় তারা রীতিমতো জিম্মি।
ফি নির্ধারণ করে দিয়ে গত ১৮ নভেম্বর এক নির্দেশনা জারি করেছে মাউশি। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো (এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন) শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শুধু টিউশন ফি গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি গ্রহণ করবে না বা করা হলে তা ফেরত দেবে অথবা তা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করবে। এছাড়া অন্য কোনো ফি যদি অব্যয়িত থাকে, তা একইভাবে ফেরত দেবে বা টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করবে।

শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার এ প্রবণতার শেষ কবে? ছবি : এশিয়ান পোস্ট
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, যদি কোনো অভিভাবক চরম আর্থিক সংকটে পতিত হন, তাহলে তার সন্তানের টিউশন ফির বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিশেষ বিবেচনায় নেবেন। কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন যেন কোনো কারণে ব্যাহত না হয়, সে বিষয়টি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যত্নশীল হতে হবে। পাশাপাশি বলা হয়, ২০২১ সালের শুরুতে যদি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, তাহলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন, উন্নয়ন ফির নামে অর্থ নিতে পারবে না।
এদিকে পাড়া মহল্লার ছোট ছোট ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতেও চলছে একই অবস্থা। কোনো নিয়ন্ত্রণেই নেই এসব প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে ঢাকার আগা খান স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক হোসনে আরা জামান বলেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের একজন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাতা হিসেবে আমি অবশ্যই চাইব এই ধরনের সব স্কুল একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে। প্রতি বছর সেশন চার্জ নেয়ার সপক্ষে স্কুল মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের অবশ্যই জোরালো যুক্তি প্রদর্শন ও শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা উপস্থাপন করে কেবলমাত্র এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো শুধু মাত্র কিছু ব্যবসায়ীর লাভজনক প্রতিষ্ঠান না হয়ে যথোপযুক্ত সুনাগরিক তৈরিতেও অবদান রাখার নিরলস প্রচেষ্টায় সচেষ্ট হতে হবে।