বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা বলেছেন, আমরা দু’বোন একে অপরের পাশে আছি। দুজন দুজনকে সাহায্য করি। খুব ভালোবাসি।
গতকাল বুধবার (১৭ মার্চ) বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে শেখ রেহানা ছোট শিশুদের কাছে ‘আমার বাবার ছেলেবেলা’ শিরোনামের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর শৈশবের নানা ঘটনার সঙ্গে এ মহামানবের একান্ত ব্যক্তি জীবনের কথাও তুলে ধরেন।
বক্তৃতায় শেখ রেহানা শতবর্ষ আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মলগ্ন প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই শিশুর আগমনে আজানের ধ্বনি, মধুমতি নদীর ঢেউ, পাখিদের কলতানে পুরো গ্রাম যেন আনন্দে মেতে উঠে। সারা গ্রামে মিষ্টি ও খোরমা বিলানো, গরিব দুঃখীদের মাঝে কাপড় বিলানো, মিলাদ পড়ানো নানা আয়োজনে উৎসবে পরিণত হল গ্রামটি’।
তিনি বলেন, ‘আমার দাদা-দাদি, ফুফু, মায়ের মুখে শোনা এবং আব্বার নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি এসব গল্প’।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব নিয়ে শেখ রেহানা বলেন, ‘সব শিশুদের চেয়ে মুজিব ছিলেন একটু অন্যরকম। বাড়ির মুরুব্বি, শিক্ষক, কৃষক, মাঝিভাই সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করতেন- এই বাচ্চাটা অন্যসব বাচ্চা থেকে একটু অন্যরকম। এই বাচ্চার মনটা অনেক বড়, অনেক পরোপকারী। কারও দুঃখ কষ্ট দেখলে এগিয়ে যাওয়া, নিজের জামা খুলে অন্যের গায়ে তুলে দেওয়া, খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া দেখে মুগ্ধ নয়নে সবাই তাকাতো, আর দোয়া করত’।
বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘ছোট্ট মুজিব সব কিছু জানতে চাইতেন। বাবাকে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতেন, তার বাবাও ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তিনি বই পড়ে শোনাতেন বড় বড় মানুষের কথা, ধর্মের কথা, বিজ্ঞানের কথা। আবার দাদা আর আমার আব্বা মুজিব ছিলেন ঠিক বন্ধুর মতন। দাদা যেমন শ্রদ্ধা আর সমীহ করে চলতেন, তেমনি সবকিছু তার সাথেই নি:সংকোচে আলোচনা করতেন। কোনো দিনও তার খোকাকে কোনো কাজে বাধা দিতেন না।’
শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার দাদা প্রচুর বই কিনে আনতেন। ইতিহাস, ভুগোল, ইংরেজি, বাংলা, ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, বড় বড় মনীষীদের জীবনী, ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা। তিনি নিজেই ছেলেকে পড়ে শোনাতেন।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়া গ্রামের কিছু ঘটনা তুলে ধরেন শেখ রেহানা। তিনি বলেন, ‘একবার এলাকায় খুব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো। ফসলের অনেক ক্ষতি হলো। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার। ছোট মুজিবের মনে মানুষের জন্য অনেক কষ্ট। দাদা দাদিকে বলে আমাদের গোলা ঘর থেকে ধান চাল বিলানো শুরু করলেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে যাদের নেই তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি’।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে শেখ রেহানা বলেন, ‘একবার আমার দাদা কলকাতা থেকে সুন্দর একটা চাদর কিনে আনলেন মুজিবের জন্য। মুজিব সেটা পরে বাইরে বের হলেন ঘুরতে। ফেরার পথে দেখেন জীর্ণশীর্ণ একজন বয়স্ক মানুষ গাছের নিচে বসে প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে। আব্বা সেটা দেখে নিজের চাদরটা তার গায়ে পরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসলেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে’।
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে মুজিবের গোপালগঞ্জ শহরের কিশোর জীবন সম্পর্কে শেখ রেহানা বলেন, ‘টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে এনে মিশনারী স্কুলে ভর্তি করা হলো মুজিবকে। বাবার সঙ্গে তিনি গোপালগঞ্জ শহরেই থাকতেন। এই সুদর্শন বালক, চোখে চশমা- ক্লাসের সবার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। বয়সে বড় দেখে ক্লাসে সবাই মিয়াভাই ও ভাইজান বলে তাঁকে ডাকতেন’।
বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে পুত্র মুজিবের সম্পর্কও বক্তৃতায় তুলে ধরেন শেখ রেহানা। তিনি বলেন, ‘কিশোর মুজিবের নাম তখন গোপালগঞ্জে অনেক জনপ্রিয়। যত সুনাম হতে লাগল, ততই কিছু ছাত্র-মানুষের হিংসার পাত্র হয়ে উঠতে লাগল সে। আজেবাজে নালিশ করে দাদার কান ভারী করার চেষ্টা করতে লাগল। বাবা শেখ লুৎফর রহমান সাহেবের সন্তানের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। খোকা কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। দু একটা দুষ্টুমিতো জানতোই। বাবা জানতে চাইলে উনি মাথা নিচু করে দোষ স্বীকার করতেন’।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের প্রভাব তুলে ধরে শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার আব্বার জীবনে শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন সবচাইতে শ্রদ্ধার পাত্র। তার শিক্ষাগুরু’।
নিজের মা-বাবার সহযোদ্ধাময় দাম্পত্য জীবন সম্পর্কও বক্তৃতায় তুলে ধরেন শেখ রেহানা। তিনি বলেন, ‘মুজিবের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন রেনু। জীবনে চলার পথে এমন কিছু ছিল না যে, দুই বন্ধু মিলে আলোচনা না করতেন এবং একইসাথে পৃথিবী থেকে দু’জন বিদায় নিয়েছেন’।