fbpx

কবিতার জন্যে নিবেদন চিরদিন

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

নদীকে তো নদীই মনে হয়, নিরন্তর বহে চলা জলের প্রবাহ; নদী এতদাঞ্চলে হিমালয় দুহিতা। তবু নদীদের কেন এত ভিন্ন ভিন্ন নাম? আর জলপ্রবাহও কি সব নদীর একইরকম? নদীদের দুই তীরও সর্বত্র একইরকম নয়। দুইপাড়ে যে হাজার বছরের জনপদ, নদীর; তার চেহারাও কত ভিন্ন, কত যে চরিত্রের। কোনও কোনও নদীর নাম সর্বনাশী, করাল গ্রাসী, আবার কোথাও ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা’। কোনও নদী দুঃখ, কোথাও নদী নিজেই ভাটিয়ালি, কোথাও নদী নৌকা বোঝাই স্বপ্ন, কোনও কোনও হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনের অভিপ্রায়মাখা ভালোবাসা। কোথাও কি নদী কবিতার পাণ্ডুলিপি? নদী যদিও নদী, নদী কি আংশিক নারী নয়? সব নদী এক নদী নয়। সব নারী এক নারী নয়। পাণ্ডুলিপির সব কবিতাও এক কবিতা নয়। একই নদী প্রবহমান অবস্থায়ও যেমন বাঁকে বাঁকে বাক বদলায়, একজন কবির কবিতা-বিরচন ভঙ্গিও দিনে দিনে বাঁক বদল করে। তাই কবিতাও আলাদা আলাদা নাম নিয়ে প্রকাশিত হয়। কবিই প্রকাশিত হতে থাকেন তাঁর অভিজ্ঞানের ভেতর দিয়ে। সেই প্রকাশনা এক একজন কবির এক একেরকম। আবার একই কবি, সেই প্রবহমান নদীর বাঁক বদলের মতো অটোমেটিক বদল্প্রয়াসি হতেই থাকেন। আর অভিজ্ঞান, তা উন্মুক্ত হতে থাকে শব্দবাক্যভাষার জাদুতে। কবিই সেই জাদুকর, যিনি কয়েকটি শব্দবাক্য ছুড়ে দিলেই রুমালের ভেতর থেকে কবুতর উরে যায়। ভালোবাসায় ভরা একটি বঞ্চনাহীন সমাজকাঠামোর দিনে কবি পৌঁছে যেতে চান তাঁর জনপদের মানুষকে নিয়ে। যা চান একজন শিল্পী-দার্শনিক বা সর্বোপরি একজন রাজনীতিক। একজন কবির মনোজগতে কি অদৃশ্য দার্শনিক ঘুমিয়ে নেই? শূন্যতা থেকে বাক্য ধরে এনে গেঁথে দিচ্ছেন কবি, সেই বাক্যের অভিঘাতে চিড়চিড় করে ওঠে যা পাঠকের অন্তর, সেই চিড়চিড়ানি অস্বীকার করে আমাদের ছাপাখানার পৃথিবী এগুতে পারবে? কবিই কি ব্রহ্মা নন?

কবিতার ভেতর দিয়েই কবিকে বুঝতে পারে পাঠক, আমরা। কবির চিন্তা-দর্শন-অভিজ্ঞানের সঙ্গে পাঠক কবিতার ভেতর দিয়ে নিজ নিজ চিন্তা-দর্শন-অভিজ্ঞান মিলিয়ে নিতে পারে। কিছু যেমন মিলতে পারে, কিছু অমিলও থাকতে পারে। এভাবেই আমরা একজন কবিকে আবিষ্কার করে উঠি। সেই আবিষ্কারই আমাদের আনন্দ, আমাদের ভালো লাগা। পুরাণের কলিযুগের পর আজকের ডিজিটাল যুগে এসে আমরা হয়তো অনস্বীকার্য এমন এক অস্থিরতায় কম্পমান যে, কবিতার রসশিল্পে সিক্ত হওয়ারও সময় হয়তো পাচ্ছি কম। তাহলে কবিকে আবিষ্কারের আনন্দ গাহন করব কখন? কিন্তু একটা কথা বলা হয় যে, কবিতা এক ধরনের অসুখ, যাকে ধরে, কোনও চিকিৎসকই অসুখ নিরাময় করতে পারেন না। কবিতা অসুখ বাধিয়ে দেয় আবার কবিতাই কবিতার অসুখে পড়া মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। সেই অর্থে কবি হয়ে ওঠেন মনোজগতের কবিরাজ। যেমন চন্দ্রমোহ আমাদের কাউকে কাউকে গোপনে ডেকে নিয়ে যায় মাঠের প্রান্তে, জোছনা গাহনে; যেমন জলোচ্ছ্বাসে গর্জন তুলে ডাক দেয় বঙ্গোপসাগর, ডাক দেয় আদিবাসী পাহাড়, ডাক দেয় কবিতাও। কবিতা ঘুমিয়ে থাকে থাকে ছাপাখানা থেকে ফেরা কাগজের পৃষ্ঠায়, পাঠক পড়তে গেলেই সেই কবিতা তখন জেগে ওঠে, ভাব বিনিময় করে, ভাবনা এসে জমতে থাকে মাথায়, মাথার মধ্যে তখন মহাকাশ, অনন্ত নক্ষত্র দানা। এইভাবে প্রহরান্ত পাশ ফেরে। হয়তো এক পশলা হাওয়া আসে ঝিলের কিনার থেকে, আমরা বেঁচে থাকি, আমরা বেঁচে থাকতে চাই। আমরা ভালোবাসার সঙ্গে বেঁচে থাকতে চাই। তাই কবিতার কাছে যাই। কবিতাকে ভালোবাসলেই তো টের পাওয়া যায়, দক্ষিণের হাওয়ায় কেন ভেসে আসে ঘ্রাণ, চমদ্রমল্লিকার! কবি বলেন _

অজ্ঞাত তারার মতো
আমাদের প্রেম ভালোবাসা
সুন্দরের সন্নিকটে ছুটে যায় পতঙ্গের মতো
গোপন ইচ্ছার শিখা জ্বলে শিরা ধমনীর রক্তের অঙ্গারে
যেন সাদ্ধোয়া তুলসীপাতা
কাঠখোট্টা ভালোমানুষেরা_যাদের সান্নিধ্যে মেলে না কিছুই_
উপমিত বিরল সুন্দর ভয় করি_সেই তারা
অসতের দুঃসহ কলঙ্ক রটাবে মুখরোচক
হৃদয়ের সততার সংজ্ঞা বিচার আদৌ না বুঝে
ভালোবেসে অবশেষে দুজনের অভিজ্ঞতা হয়_
ভালোবাসা ঠিক অস্থির রেহালে দাঁতাল করোটি;

কবিতাটি প্রকাশিত ‘অনল স্রোতের জলযাত্রী’ কাব্যগ্রন্থে। কবি আসাদুল্লাহ। কী নির্মম সত্য উচ্চারিত হয় কবির মুখে! মানুষের সম্পর্কের অন্তর্জগৎ তুলে আনেন কবি। আসাদুল্লাহ উচ্চারণ করেন, ‘আমারি জন্যে তোমারি ভালোবাসা, দুজনে দুজন এক সর্বোত্তম ফুল্ল অভিব্যক্তি, একমেবা দ্বিতীয়ম তুমিও কি তাই অষ্টি প্রেমে?’ এই ভালোবাসাই তো চিরকাল চেয়ে এসেছে প্রেমিক, তাঁর মনোনীতার কাছে। ভালোবাসার জন্যেই মানবজন্ম, মানুষের ভালোবাসাই চিরকাল শ্রেষ্ঠ কবিতা। ফলত, কবি ভালোবাসাকেই উপাত্ত করে নেবেন, নিয়েছেন, যা স্বাভাবিক। তাই আমরা দেখতে পাই, কবির স্বভাব বা কবির জন্যে যা স্বাভাবিকতা, তার স্বরূপ তিনি কোনও না কোনও কবিতায় তুলেই ধরেন। কবি আসাদুল্লাহও হৃদয়ের প্রার্থনা জারি রেখে বলেন_ ভালোবাসার কিয়ামত নেই।

কেউ নেই কিছু নেই, আমরা দুজন
তন্দ্রাচ্ছন্ন অভিযাত্রী বেহুলার স্বর্গমুখি ভেলা,
সবটুকু ভালোবাসা আমারই নবুয়ত
সুদ পূতঃ সিদ্ধগুরু তুমিই আমার জিব্রাইল,
প্রেমের পয়গম্বর আমি, লা-রাঈবা ফীল;
এস্কের ফায়েজ সহি, হায়াত বিগাইরি হিসাব…

প্রবল প্রেমের দিকে ধাবমান কবি আসাদুল্লাহ। ছোট্ট মানবজীবনে প্রেমের জন্যেই তো এত কিছু। এত নির্মাণ, বিনির্মাণ, যাপনের ক্লান্তি ও ম্রিয়মাণ পার হয়ে এসে প্রেম ছাড়া আর কিসেই বা মুক্তি মিলবে মানুষের? আসাদুল্লাহর কবিতার গাঁথুনিতে চোখে পড়ে_তিনি সন্তর্পণে কিছু কাজ করেছেন এমন ভাবে, খুব মনোযোগ দিয়ে না পাঠ করলে সেটি ধরা যাবে না। শব্দকে তিনি ভেঙেছেন, ভেঙে সেই শব্দে বিস্তৃতি বাড়িয়ে নিয়েছেন বা পাঠকের জন্যে বিস্তৃতি বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিনির্মাণের শব্দ থেকে অর্থকে আরও ঘনীভূত ও দ্যোতনাময় করে তুলবার অধিকার শুধু কবিরই, কেন না কবি ব্রহ্মা। কেন না, আদিতে ধ্বনি শব্দ ছিলেন, শব্দ বাক্য ছিলেন, বাক্য ওঙ্কার ছিলেন। কবির শ্বাসপ্রশ্বাসই ওংকার, ওঙ্কারই কবিতা। কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিপুত্র বলেছেন, কবিতা অনেকরকম। হ্যাঁ, নদী অনেকরকম। হোয়াংহো যেরকম, তুলসীগঙ্গা সেরকম নয়। বুড়িগঙ্গা আরেকরকম। ‘আমি একশোতে এক’ কাব্যগ্রন্থের একটি সনেটে আসাদুল্লাহ লিখেছেন_

প্রেম কানটানা মাথা, চায় হিংসা, ভালোবাসা চায়
শত্রুতা; মুক্তির পথ একই আখেরে দুনিয়ায়
শাশ্বত শপথ সেই দাসত্বের, মনের প্রত্যাশা
আইনুল ইয়াকিন, প্রত্যক্ষণ, দুয়ের দর্শনে
মৃত্যু হত্যার সংসার-জ্যান্ত মরা, প্রেম আকিদায়;
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতো দেহভান্ড বিশাল ময়াল
মহাজনি বেসাতের, সচেতন মনের কয়াল
মাপে ঠিক রাখে সূক্ষ্ম রতির ওজন, ভালোবেসে
বড়দায় দান হয় দানের অতৃপ্তি, অন্যসুখে
সঞ্জীবন, দেহিবিশ্ব নবীনূরে নূরানি সয়াল;

বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে কবি আসাদুল্লাহর নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থ। পৃথকভাবে পূর্বে প্রকাশিত নয়টি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতাকুসুম নিয়েই এই নির্বাচিত কবিতার সমাবেশ। অবশ্য এই নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থেরও একটি পৃথক নামকরণ করা হয়েছে, সেটি ‘প্রতিকৃতি শব্দশিলা’। অনেকটা এগিয়ে এসে একদিন যেমন আমরা পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, তাকালে কী দেখতে পাই? কবি আসাদুল্লাহ কী দেখতে পান? যে বাক্য রচিত সকালে বা দুপুরে, সন্ধ্যায় সেই বাক্যের মুখোমুখি হওয়া প্রায়? হয়তো তিন দশক কাল পার করে এসেছেন তিনি, পথে পথে বাক্য কুড়িয়ে এসেছেন, কবিতা কুড়িয়েছেন, আজ সেই সব কবিতার দিকে যেন ফিরে তাকানোই এই নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ_প্রতিকৃতি শব্দশিলা। এ কি নিজের দিকে ফিরে দেখা নয়, কেমন করে কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে এত বৎসরান্তের দিনরাত পার করা আসা যায়? অনেক কবিই তো কবিতা থেকে ছিটকে যান জাগতিক আগ্রাসনে, সেই আগ্রাসন মোকাবেলা করে থাকা কঠিন বটে। এখনো কবিতায় সক্রিয় কবি আসাদুল্লাহর সঙ্গে আমরা যেতে চাই পাড়ি দেওয়া তাঁর সময়ের কাছে, তাঁর উপলব্ধির কাছে। তিনি বলছেন_

আমার আমির নেই বিনষ্টি কস্মিনকালে, শুধু
নিত্য পরিচয়, একি! মহা ঐক্য! অতীতের ধুধু
স্মৃতির স্বরূপে এক, বৈচিত্র্যের মহান একতা
ভাবের রহস্যে, আশা আমূল মিলনে, জীবনের
বড় প্রেম নৈসঙ্গের ণয়, পাথেয় জলের মধু;
লক্ষ কোটি ঘরে কুপি বাল্ব জ্বলে, একই কিরণ
জানি নূর জহরায়, নূরচুয়া রূপের ধরন
যেন ঝর্ণাতোয়া নদী কিম্বা সৃষ্টিবতী আদি সেই
বীজ, আমাতে নিহিত মহাসত্য! আসরারে খুদী
বুঝি না, বিবর্তনের ধারা জন্মান্তরের করণ;
আমি একাই একশ একশোতে এক, সত্য যে তা
মানুষে মানুষে এক গুপ্ত ব্যক্ত…

বাংলা কবিতায় আরবি ও ফারসি শব্দের চমৎকার ব্যবহার দেখি আসাদুল্লাহর কবিতায়। ফারসি বা আরবি শব্দের ব্যবহার পাঠকের জন্যে নতুন বাংলা ভাষায় নতুন ধ্বনি, যে রকম ধনি ধরেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহম্মদ বা আহমদ ছফাও। কত ভাষা থেকেই না শব্দ এসেছে বাংলা ভাষায়, বাংলা কবিতার শক্তিকে শাণিত করেছে, আসাদুল্লাহ নির্দ্বিধায় শব্দকে ধরেছেন, শব্দকে আদর করে কবিতায় রোপণ করেছেন। কবিতার শ্বাসমূলে যে ছন্দ প্রবাহিত, আসাদুল্লাহ ছন্দের নির্মিতিতেও দারুণ নিরীক্ষাপ্রবণ। আত্মার অধিক হলে আমরা বলি আধ্যাত্মিক, কবি আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ ছুঁতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের জনমানসে আধ্যাত্মিকতার একটা বিরাট জায়গা আছে। যে জন্যে এত পীর-কামেল-মুর্শিদ আমাদের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। কবি আসাদুল্লাহ তাঁর কবিতায় মর্মর প্রেম রচনা করেন। বলা যায়, প্রেম আকীর্ণ করেছে তাঁর কবিতাকে। মানবেতিহাসে আছে যুদ্ধ, আছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, আছে হত্যা, মৃত্যু, কিন্তু কোন দিকে মানুষ বেশি তাকিয়ে ছিল বা থাকিয়ে থাকে তাঁর জীবদ্দশায়? অবশ্যই প্রেম। কবি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসার কাছেই নতজানু চিরকাল। কবি সেই প্রেমকেই উর্ধে রেখেছেন, কবি সেই প্রেমকেই ছড়িয়ে দিতে চেয়ে একটি জীবন পার করে দেন অবলীলায়। কবির নির্মিতি ভেঙে দেয় আমাদের পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতা, কেন না, আমরা জানতাম, জুলেখা বাদশার মেয়ে, তাহার ভারি অহংকার। কবি বললেন, জুলেখা কবির মেয়ে। কবি বললেন, পার্বতীর মতো জুলেখারে বানাবো জরিনা। কবি বললেন, পোস্টমাস্টারের রতনের মতো জুলেখা হবে সখিনা। কবিতার অন্তর্গত যমুনার জলে অনুরাধা জুলেখা কবির মেয়ে। চমৎকার রসবোধ তৈরি করেন আসাদুল্লাহ তাঁর কবিতায়। পাঠকের জন্যে তা নতুন স্বাদ তৈরি করে। একজন আধুনিক কবির এই রসবোধ থাকা চায়, তিনি বাদশার মেয়ে জুলেখাকে বানালেন মোল্লাবাড়ির জুলেখা। যে কিনা একদিন হয়তো কবিরই সতীর্থ সাথী ছিল। বাল্যপ্রেম স্মৃতি হয়ে থাকে। বালকবেলার দেখা মাঠই হয়তো সারাজীবন মাঠস্মৃতি হয়ে থাকে, কিশোরবেলার আকাশই হয়তো সারাজীবন নীল হয়ে ছড়িয়ে থাকে মাথার মধ্যে। মাথার মধ্যে যে মহাকাশ কবির, তার সন্ধান পাবে না বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, রাডার ফাঁকি দিয়ে থাকা সেই মহাকাশ বিস্তৃত শুধু কবির মাথাতেই থাকে। সেই জন্যেই এক একটি কবিতা এসে কবিকে লিখতে বাধ্য করে, কবি ‘সকল লোকের মাঝে বসে, নিজেরই মুদ্রাদোষে একা ও আলাদা হতে’ থাকেন। এই হয়তো কবির নিয়তি। আসাদুল্লাহ কবি, তিনিও সকল লোকের মাঝে বসে একা হয়ে পড়েন। হলেও, প্রেম কবিকে ছাড়বে না। অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে প্রেম। কবির প্রার্থনাও তাই এরকম যে, তিনি বলেন_

উড়ুক্কু মনটা দেখি নিবেদন চায়
শয্যার আসন নিবি তুই ছবি আজ
ভয় কী রে নিয়তেই কর্মফল, আয়
নামাজ বানাব তুই হ জায়নামাজ।

প্রেমে ও প্রার্থনায় কবি একাকার। যুগে যুগে প্রেম ছিল, আছে, থাকবে, প্রার্থনা ছিল, আছে ও থাকবে। আসাদুল্লাহ উচ্চারণ করেন_

তুমি বৃষ্টি, আমি ক্ষরা। তুমি মেঘ, আমি মরু। তুমি
সুনীল, আমি সবুজ…
তুমি ধ্বনি, আমি শব্দ, তুমি ভাব, আমি আমি ভাষ্য।

শব্দশিলা হয়ে কবির প্রতিকৃতিই ধরা পড়েছে প্রতিটি কবিতায়। সেই কবিতাসমূহ থেকেই নির্বাচিত এই কাব্যগ্রন্থে। ‘জন্মদেশ প্রত্নপত্র’ ‘ভালোবাসাবাসি’ ‘মুজিব অনন্য অচিন্ত্য মা’ ‘পীড়িত রোহিঙ্গা পোড়া আবাসন’ ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ ‘তর্জনির রূপকল্প’ ‘অনল স্রোতের জলযাত্রী’ ‘আমি একশতে এক’ ও ‘আকার এবং ওয়াই’ আসাদুল্লাহর কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাই প্রকাশিত হচ্ছে ‘ ‘প্রতিকৃতি শব্দশিলা’। সব কবিতাই তো শেষ বিচারে কবির প্রতিকৃতি, সেই প্রতিকৃতি শব্দে শব্দে প্রতিভাত কবিতায়। শিলার মতন। একজন কবিতাপাঠকের কাছে এ এক সম্পদ। এ এক ফলের বাগান। বাগানে বিচিত্র ফল। বিচিত্র তার স্বাদ, অনুভব। আসাদুল্লাহ এই স্বাদ-অনুভব তুলে ধরেন পাঠকের অন্তরে। এটাই কবির শক্তি। জল, কিন্তু নদী যেমন আলাদা আলদা; একেকটি কবিতারও আলাদা আলাদা গঠন, গতিপ্রকৃতি নিয়ে ধাবিত সংবেদনশীল পাঠকের দিকে। পাড়তে পড়তে, ধীরে ধীরে রস নিতে পারার সুযোগ সামনেই, যদি কবিতার বইটিই সামনে নিয়ে ধ্যানযোগে বসা যায়। যে পাঠক কবিতায় পিপাসা মিটিয়ে থাকেন, এই গ্রন্থ তার জন্যে। যে মানুষ একা একা নিজের মুখোমুখি হতে ভালোবাসেন, সময়কে দেখতে চান অদৃশ্য আয়নায়, প্রতিকৃতি শব্দশিলা তাকে নতুন নতুন অর্থবোধকতায় পৌঁছে দেবে। কবি আসাদুল্লাহর কবিতার সঙ্গে কবিতাপাঠকের সেই মুখোমুখি বসবার সময়টাও কবিতাময় হয়ে ওঠে।

বাঙালি ও বাংলা ভাষা আসাদুল্লার কবিতার একটা অন্যতম অনুষঙ্গ। বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর কবিতায় উৎকীর্ণ, যেন বা পঙক্তিময় ফলক হয়ে আছে একেকটি কবিতা। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে আসাদুল্লাহ তাঁর কবিতায় বুনন করেন, সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত সেই বুনন ভঙ্গি। নদী যেমন আত্মস্রোতের প্রবাহে মগ্ন, আপন বিভায় উচ্ছ্বাসপ্রিয়, প্রতিকৃতি শব্দশিলার কবি আসাদুল্লাহর কবিতাও স্বতঃস্ফূর্ত, সহজাত, সাবলীল। জোরজবরদস্থি করে কবিতা বানানো থেকে তিনি দূরে দাঁড়ানো কবি, বিপরীতে তিনি আত্মমগ্ন প্রেমে দায়বদ্ধ। তাঁর কবিতাতেই উঠে আসে সেই প্রেম, সেই প্রেম নারীতে নিবেদিত বটে, নিবেদিত সুন্দরেও। নারী সুন্দর। নদী সুন্দর। ফসলের মাঠ সুন্দর। কবি বলেন_

সুন্দরের এত রূপ, এত শিহরণ!
ছায়াপথের ওপারে নীহারিকাপুঞ্জ থেকে ছুটে
আসে তাঁর গুচ্ছ গুচ্ছ সুন্দরের ধারাজল সৃষ্টি

মৌনসুন্দর
সুন্দরের সুরগঙ্গা জীবনসুন্দর, মৃত্যুসুন্দর
আকাশের তারাফুল প্রিয়ার খোঁপায় সুন্দরম
অশ্রুসুন্দর, সে ঋত্বিক জীবন্সুন্দর।

‘কিংবদন্তি শাইরুর প্রেম’ এমন একটি আখ্যানধর্মী কবিতা, যা আসাদুল্লাহ লিখেছেন একটি পাহাড়ি মিথকে অবলম্বন করে। সেই কবিতার প্রথমেই আমরা পড়তে পাই,

এ পাহাড় শাইরুর প্রেমের পাহাড়,
এ পাড়া শাইরুর।
নাম না জানা প্রেমিকের স্মৃতিপাহাড়,
আদিবাসী এক প্রাণোচ্ছল তরুণী শাইরু…

মিথময় অন্য সব প্রেমের মতোই এই কবিতাতেও আসাদুল্লাহ তুলে এনেছেন প্রেম ও ট্র্যাজেডি। জোড়াগাছ সাক্ষী হয়ে আছে শাইরুর পাহাড়ের চুড়ায়। আসাদুল্লাহ এমন এক প্রেমময় মিথআখ্যানকে কবিতায় ধরবেনই, কারণ, কবি ছাড়া প্রেম যথার্থ হয় না। যেমন, বসন্ত ছাড়া কোকিল সচরাচরর নয়। যেমন, অন্ধকার ছাড়া জোনাকির আলো দেখা যায় না। নানারকম স্বাদের প্রায় দুশোর অধিক কবিতা নিয়ে কবি আসাদুল্লাহর নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতিকৃতি শব্দশিলা।’ একজন কবিকে গ্রহণ করে নেবার জন্যে যথেষ্ট, দুশো কবিতা। কবিই ঈশ্বর, সুতরাং যা রচিবেন কবি, তাই মহার্ঘ। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,

কেউ যাহা শোনে নাই কোনও এক বাণী
আমি বহে আনি

সুতরাং, কবি শূন্যতা থেকে বাক্য ধরে আনেন। পাঠক পড়েন। কবির সকল কবিতাই সফল হয় না, অসফলও হয়। আসাদুল্লাহর সফল কবিতা ও অসফল কবিতার ভার পাঠক বিচারে আলাদা আলাদাই হবে। তাই হয়। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতিকৃতি শব্দশিলা প্রকাশের আয়োজন প্রায় সমাপ্ত। প্রকাশের পর পাঠক আদর করে আসাদুল্লাহর কবিতাকে পড়ে বিচার করবেন, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি। কেন না, কবিতার অসুখ আমার ছেলেবেলা থেকেই…

জয় হোক বাংলা কবিতার, জয় হোক কবির। রফিক আজাদ বলতেন, কবি ছাড়া জয় বৃথা। যেমন, কবিতা ছাড়া সুন্দর বৃথা। তাই কবির জন্যে ভালোবাসা, চিরকাল। কবিতার জন্যে নিবেদন চিরদিন।

Advertisement
Share.

Leave A Reply