বাঙালির ভবঘুরে ব্যথিত সিনেমাওয়ালা ঋত্বিক ঘটক । এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে তার পরিচালিত ছবিগুলো একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। ঋত্বিক ঘটক নামে যিনি সমাধিক পরিচিত। ভারতবর্ষের মননশীল জীবনবাদী ছবির জগতে যাদের নাম আলোচিত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঋত্বিক ঘটক।
বিপ্লবী চলচ্চিত্রকারের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর।। ১৯২৫ সালে আজকের এই দিনে ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি।ঋত্বিক কুমার ঘটকের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তার চলচ্চিত্রে দেশভাগ এবং এ বিভাজন থেকে বেদনা আর উদ্বাস্তু হওয়ার মর্মন্তুদ কাহিনী যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, দুই বাংলায় আর কোনো পরিচালকের কাজেই তার প্রতিফলন ততটা নেই। দেশ ভাগের যন্ত্রণা উদ্বাস্তু জীবন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রেই সবচেয়ে জোরালোভাবে হাজির হয়েছে। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্যে বরাবর আস্থা রেখে গেছেন ঋত্বিক। দেশভাগ কখনই তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এ বিষয়ে তিনি প্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন সারা জীবন।
চলচ্চিত্রে আসার কথা ছিল না। তাঁর স্বপ্নের সমস্তটা জুড়ে ছিল নাটক। ঋত্বিক সিনেমাতে এসেছেন, কারণ সিনেমা একসাথে বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়।
‘নাগরিক’ তাঁর প্রথম সিনেমা হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নয়। ‘নাগরিক’ বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়নের গল্প। সাতাশ বছরের ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৭৭ সালে। ১৯৫৫ সালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে ডকুমেন্টারি ছবি করলেন ‘ওঁরাও’।
হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।১৯৫৮ সালে প্রথম সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পায়। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। বাড়ি থেকে পালানো এক ছেলের চোখে শহরকে দেখার গল্প।
এরপর একে একে মুক্তি পায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এগুলোর প্রথম তিনটি সিনেমাকে ত্রয়ী বলা হয়। দেশভাগের ফলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে যে শরণার্থী সমস্যা তৈরি হয় তাই-ই ছিল ত্রয়ীর মূল বিষয়বস্তু। ঋত্বিক দেখিয়েছেন দেশভাগ কি করে কোটি কোটি পরিবারকে উদ্বাস্তু করেছে।
ঋত্বিকের সবগুলো সিনেমার চেয়ে শেষের দুটি একেবারে আলাদা। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের উপর নির্মিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাটি এক মালোপাড়ার জীবনপ্রবাহের প্রতিচ্ছবি।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে (আইপিটিএ) যোগদান করেন। এসময় তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশ্ট ও নিকোলাই গোগোল-এর রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। এই বৎসরে তিনি নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। এই ছবিতে তিনি অভিনয় করেন এবং সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন।
জীবদ্দশাতেই চলচ্চিত্রে নিজের অবদানের জন্য ঋত্বিক অর্জন করেছেন বহু সম্মাননা। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী উপাধি। ঋত্বিক কেবল এই উপমহাদেশের একজন মহান শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ শিল্প শিক্ষকও। ১৯৬৩ সালে ভারতের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে দু’বছর কাজ করেছেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন আরও ৩ মাস।
ঋত্বিক ঘটকের সামগ্রিক চলচ্চিত্র বিষয়ক কাজগুলো জেনে নেয়া যাক। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র : নাগরিক (১৯৫৩) (মুক্তিঃ ১৯৭৭, ২০শে সেপ্টেম্বর), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৯), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬১), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), তক্কো গপ্পো (১৯৭৪) । তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন: আদিবাসীওন কা জীবন স্রোত (১৯৫৫) (হিন্দি, বিহার সরকারের অনুদানে তৈরী), বিহার কে দর্শনীয়া স্থান (১৯৫৫) (হিন্দি, বিহার সরকারের অনুদানে তৈরী), সায়েন্টিস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কৌন (১৯৭০) (হিন্দি), আমার লেলিন (১৯৭০), পুরুলিয়ার ছাউ (১০৭০)। ঋত্বিক স্বল্প-দৈর্ঘ্যে ছবি নির্মাণ করেছেন : ফিয়ার (১৯৬৫) (হিন্দি), রেন্ডিজভোয়াস (১৯৬৫) (হিন্দি), সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫), দুর্বার গতি পদ্মা (১৯৭১)। তাঁর অসমাপ্ত কাজের মাঝে রয়েছে- ফিচার: অরূপকথা/বেদেনী (১৯৫০-৫৩), কত অজানারে (১৯৫৯), বগলার বাংলাদর্শন (১৯৬৪), রঙের গোলাম (১৯৬৮)। ডকুমেন্টারী : উস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩), ইন্দিরা গান্ধী (১৯৭২), রামকিঙ্করঃ এ পারসোনালিটি স্টাডী (১৯৭৫)।
বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অনবদ্য কবিতার নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক। বাংলা চলচ্চিত্রকে যিনি দিয়েছেন এক নিজস্ব ভাষা, শিল্প রূপের অন্যরূপ।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঋত্বিক কাউকেই কাছে পাননি, মৃত্যুর সময় স্ত্রী সুরমাও ছিলেন বহু দূরে। বিশৃঙ্খল আর বেপরোয়া জীবন আস্তে আস্তে তাঁকে শেষ করে দিচ্ছিলো। ঋত্বিকের শেষ সময়গুলোর সাক্ষী ছিলেন আরেক চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে তিনি কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।