fbpx

ঢাকায় চায়ের ফিরিস্তি

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

আল মারুফ রাসেল। জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৩ নভেম্বরে পুরনো ঢাকায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলাবাগানে। পড়াশোনা প্রত্নতত্ত্ব ও আলোকচিত্র নিয়ে। সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালে সমকাল পত্রিকায়। পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন সুন্দরবন বাঘ প্রকল্প ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার অ্যাণ্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন)-এ। তিনি ‘দ্য বঙ্গ প্রজেক্ট’ নামে একটি ইতিহাস গবেষণা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে ‘হেরিটেজ ওয়াক ঢাকা’ সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত।

বলা হয়, ভেষজ ওষুধ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের ব্যবহার হয়ে আসছে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। তবে তা আমদানি করা হতো চীন থেকে। মুঘলরাও নাকি চা পানে অভ্যস্ত ছিল। আর তার প্রমাণও মেলে বিভিন্ন মুঘল জাদুঘরে চায়ের পাত্র আর পেয়ালা থেকে। তবে সেটাও ঔষধি গুণের কারণেই। মুঘল সম্রাটদের নিকটাত্মীয়রা বা শাহজাদারা যখন ঢাকার প্রশাসক, তখনও কি ঢাকায় বসে এক কাপ চা খাননি তারা? কে জানে!

ঢাকায় প্রথম চায়ের দোকান কোনটা? সেটা বলা মুশকিল। তবে কোন দোকানে চা-পাতা মিলত তার খোঁজ অবশ্য মেলে ইতিহাসের পাতায়। সুশীল চৌধুরী তার ‘ট্রেড, পলিটিক্স অ্যাণ্ড সোসাইটি: ইণ্ডিয়ান মিলো ইন দ্য আর্লি মডার্ন এরা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়রা ঢাকায় বৃটিশ ও ইউরোপীয় পণ্য আনার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকায় ছিলেন। সি জে মানুক, জি এম সিরকোর, জে এ মিনাস ও আনানিয়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় এগুলো বিক্রির জন্য পশ্চিমা ধাঁচের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও খুলেছিলেন। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন জি এম সিরকোর অ্যাণ্ড সন্স চায়ের মত বিলাসী দ্রব্য সেখানে বিক্রি করতেন আর ঢাকা শহরে চা জনপ্রিয় করার পেছনে তাদেরই অবদান মুখ্য।’ বইয়ে সাল উল্লেখ না থাকলেও আর্মেনিয়ান আর্কাইভস থেকে জানা যায় সালটা ছিল ১৮৫৭।

ঢাকায় চায়ের ফিরিস্তি

এ সময়ের ঢাকাকে চায়ের দোকানের শহরও বলা চলে। ছবি : ফেইসবুক

ঢাকায় চা বাগান তৈরির চেষ্টাও কিন্তু করা হয়েছিল বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। ঢাকা ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার, শ্রী যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস, ড. মো. আলমগীরের মুসলিম বাংলার অপ্রকাশিত ইতিহাস: ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান, অনুপম হায়াতের নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি এসব বই থেকে জানা যায়, প্রথম ধাপে এই চেষ্টা করেছিলেন নবাব আবদুল গনি। ১৮৬০ এর দিকে বাইগুনবাড়িতে (সাভার উপজেলায়) ৩০ বিঘা জমি পরিষ্কার করে সেখানে চা চাষ করেন তার কর্মীরা। ১৮৬৭ সালে সেখান থেকে আড়াই মণ চা পেয়েছিলেন। নবাব আহসানউল্লাহ সেই চা-বাগানকে আরও উন্নত করেন। ১৮৯২ এবং ৯৩ সালে ঢাকা থেকে যথাক্রমে ৪ হাজার ৭০৯ মণ এবং ১ হাজার ৩৮৫ মণ চা-পাতা কলকাতায় রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানি করা এ চায়ের একটা বড় পরিমাণ উৎপন্ন হয়েছিল নওয়াবের ওই চা-বাগানে। তখনকার ঢাকা জেলার ভাওয়ালে চা চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘স্বধর্মনিরত স্বর্গগত মহাপ্রাণ রাজা কালীনারায়ণ রায় মহোদয়’। তবে যতীন্দ্রমোহন লিখেছেন,’কিন্তু কোথায়ও সুফল প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই।’ এ কারণে ১৮৯০ সালের দিকে পরিকল্পনা ত্যাগ করা হয়। তবে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার আরেকটু বাড়িয়ে এর কারণ বলেছে- অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত।

ঢাকায় চায়ের ফিরিস্তি

চায়ের চঙ যেন এ শহরের প্রাণ। ছবি : ফেইসবুক

উনিশ শতকের শেষ দশকের ঢাকার ইতিহাসের অন্যতম আকর গ্রন্থ বলা হয়ে থাকে হাকিম হাবীবুর রহমানের ‘ঢাকা: পাঁচাস বারাস পেহলে’-কে। সেখানে ছোট্ট করে এসেছে চায়ের কথা। প্রথমেই লেখক জানান দিয়েছেন ‘শুধুমাত্র সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষভাবে মোগল, আর্মেনীয় এবং কাশ্মিরী লোকেরাই চা পান করতেন।’ বলা প্রয়োজন ঢাকায় কাশ্মিরীদের আগমণও মুঘল সুবাদারদের সঙ্গেই। আর ঢাকার কাগুজে নবাবরাও ছিলেন কাশ্মির থেকে আগত।

ঢাকায় চায়ের ফিরিস্তি

কত মানুষ যে শহরে এসে জড়িয়েছে চা তৈরির কর্মে! ছবি : ফেইসবুক

ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ-এর লেখা ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সুধী থেকে জানা যায়, নবাব আবদুল গনি সকালবেলায় এক দফা চা খেতেন। ওই চা-চক্রে শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা উপস্থিত হতেন। এই চা চক্র পরিচিত ছিল গণি মিয়ার আড্ডা নামে। দুপুরের খাবার শেষে খেতেন কাশ্মীরি চা। রাতের খাবার শেষে খেতেন রং চা।

হাকিম হাবীবুর রহমান আরও জানিয়েছেন, তার বাল্যকালে শহরে একটিও চায়ের দোকান ছিল না। এক চাওয়ালা গভীর রাতে সামোভার নিয়ে ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। তিনি কয়েক পদের চায়ের বর্ণনা দিয়েছেন। সাদা চা, রূশী চা (সম্ভবত রাশিয়ান ক্যারাভান চা), দুই রকমের- নোনতা ও মিষ্টি কাশ্মিরী চা এগুলোর ভেতরে অন্যতম। তবে ‘গোলামনাবাদ’ চায়ের গল্প এখনকার কারো মুখে আর ফেরে না। এই চা ছিল বিয়ের আসরের চা। গুলকন্দ বা গোলাপের নির্যাস, দারুচিনি, লবঙ্গ আর চা মিলিয়ে তৈরি হত এই আজব শরবত।

ঢাকায় চায়ের ফিরিস্তি

ঢাকা জনপদের নিত্যপানীয় এখন এই চা। ছবি : ফেইসবুক

ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বখশ একবার এক আড্ডায় শুনিয়েছিলেন, ফরাশগঞ্জ এলাকায় নাকি ১৯২০ সাল নাগাদ চায়ের প্রচারণা চলত গানের দলের মাধ্যমে। গানের সুরে গণজমায়েতে খাওয়ানো হত বিনি পয়সার চা। ঢাকার প্রথম স্থায়ী চায়ের দোকান সম্ভবত সূত্রাপুরের খাঁ সাহেবের। দেশভাগের পর নওয়াবপুরের আমজাদিয়া, আমিনিয়া রেস্তোরা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল মালাই চা বিক্রি করে। বাংলা বাজারে ছিল মেহেরবান রেস্তোরা।
এ ছাড়া আদি ঢাকাইয়া পরিবারগুলোতে পনিরের চায়ের প্রচলন ছিল। নবাববাড়িতে নাকি চায়ের সঙ্গে ব্যবহার করা হত জাফরান।

শিক্ষাবিদ হাফিজ জি এ সিদ্দিকী ‘ঢাকা যেভাবে চা পানে আসক্ত হলো’ নিবন্ধে লিখেছেন, ব্রিটিশ কোম্পানির কর্মকর্তা খুরশিদ আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকাবাসীকে বিনা মূল্যে চা খাওয়ানোর। সহযোগীদের নিয়ে তিনি ঢাকার সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও লালবাগ থানায় চায়ের প্রচারসংক্রান্ত কাজগুলো তত্ত্বাবধান করতেন। নিয়োগকৃত ‘চা-ওয়ালা’ বিকেলবেলায় নিয়মিতভাবে রাস্তার ধারে চা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বসতেন। পরিবারের সবার জন্য চা সংগ্রহ করতে অনেকেই চাওয়ালার কাছে পাত্র নিয়ে যেতেন। একবার চা পানের আসক্তি হয়ে গেলে ঢাকাইয়ারা এর অভাব বোধ করবে, ব্রিটিশদের এ ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল যখন বিনা মূল্যে চা পরিবেশনের কার্যক্রমটি প্রত্যাহার করা হয়। তারা মহল্লার বড় কিছু মুদি দোকানে খোলা ও প্যাকেটজাত চা সরবরাহ করতে শুরু করে।

আচ্ছা, এবারে বলুন দেখি, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর গঠিত হওয়া পাকিস্তান টি বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যানের নাম কি? শেখ মুজিবুর রহমান! ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধেও তিনি আরবদের সমর্থনে মিশরে পাঠিয়েছিলেন এক বিমান ভর্তি চা। চায়ের এই কূটনীতিতে সদ্য স্বাধীন দেশেরও কম লাভ হয়নি। মিশরের তখনকার রাষ্ট্রপতি ফিরতি উপহার দিয়েছিলেন ৩২খানা টি-৫৪ ট্যাংক আর ৪০০ রাউণ্ড কামানের গোলা।

পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজারের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক আর টোস্ট বিস্কুটে কামড় দিতে দিতে ভাবি, সিরকোর সাহেবের বদান্যতায় আর ব্রিটিশ বেনিয়াদের তৈরি করা চায়ের এই বাংলাদেশি বাজার এখন রপ্তানি থেকে আমদানি নির্ভর হয়েছে। ব্রিটিশ বাণিজ্যিক কূটবুদ্ধির প্যাচে তা বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেতই বটে। কারণ ২০২২ সাল নাগাদ আমদানির থেকে রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে ৪০ গুণের কাছাকাছি। অবশ্য আমরা আদার ব্যাপারি। জাহাজের খোঁজে আমাদের কি? তাই চায়ে চুমুক দেই আর ব্রিটিশদের শাপ-শাপান্ত করি।

Advertisement
Share.

Leave A Reply