fbpx

৪৪ বছর পর বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পেয়েছেন মমতাজ বেগম

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের যে সকল মা-বোনদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন চালিয়েছিলেন তাদেরই একজন মমতাজ বেগম। বিয়ের মেহেদি তখনো তার হাত থেকে শুকায়নি। স্বামী ,শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির স্বজনদের নিয়ে নববধূটি যখন রঙিন স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি তার জীবনে নেমে আসে অমাবশ্যার কালো আঁধার। যে আঁধারে আঁধারে কেটে গেছে তার জীবনের ৬০টি বসন্ত। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছেন বীরাঙ্গনা হিসেবে। আর গত তিন বছর পেলেন বীর নারীর সম্মান।

মমতাজ বেগম কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মার ৭ মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দেখতে শুনতে ভালো। তাই ১৪/১৫ বছরেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেন একই জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার সাথে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ-মনু মিয়ার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু না হলেও দেশের অবস্থা ভাল ছিল না বলে মমতাজ বেগম জানান। তখন সারা দেশেই থমথম অবস্থা বিরাজ করছিল। বিয়ের পর দিনই স্বামীর সাথে শ্বশুর বাড়ি চলে আসেন মমতাজ বেগম।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসের কোন এক সকাল, তখন ৮টা কি ৯ টা হবে। শাশুড়ি স্বামী ও ভাশুরকে নাস্তা দিয়েছেন। সবার খাওয়া শেষ। তখন তিনি নাস্তা করবেন। ঠিক এ সময় গ্রামে খবর এলো পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করেছে। গ্রামের গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। যুবক ছেলেদের মারধর করছে আর যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর আমার শাশুড়ি বলল, বউ পালাও- একথা বলে তিনি নিজেই দিলেন দৌঁড়। এ বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসছি মাত্র ৩ মাস হতে চলল। ভালোভাবে সবার বাড়ি ঘর চিনি না। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না।

নাস্তা আর খাওয়া হল না। দিলাম হরুজী বাড়ির দিকে দৌঁড়। যেই মাত্র হরুজী বাড়ির উঠানে এলাম ওমা! এসেই দেখি ৭/৮ জন পাক আর্মি আমার সামনে দন্ডায়মান। দৌঁড়ের কারণে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। অমনি একজন আমার চুলের খোঁপা ধরে বিজাতীয় ভাষায় যেন কি বলল, বুঝলাম না। তারা একটি ঘরে নিয়ে আমাকে ব্যাপক নির্যাতন করল। বাপ ভাই ডেকেও তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না। এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান যখন ফিরে এল তখন দেখি চারদিকে অন্ধকার। চোখের পানি মুছতে মুছতে অজানা আশংকা নিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। ভাবছি হয়তো আজই আমার সংসার জীবন শেষ। স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্ত না। ঘরে ঢুকেই দেখি সবাই আমার জন্য অস্থির হয়ে আছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে বিছানায় ঢলে পড়লাম। এমন সময় আমার ভাশুর ফজর আলী, স্বামী মনু মিয়া ও শাশুড়িসহ সবাই আমাকে সান্তনা দিয়ে বলল, যা ঘটেছে তার বিচার আল্লাহ করবেন।

মনু মিয়া তার স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে পরদিন ভোর রাতেই বাবার ফুফুর বাড়ি বরুড়া উপজেলার কাশেড্ডা গ্রামে চলে গেল। যাতে পাছে লোকে মমতাজ বেগমকে কিছু বলতে না পারে।

দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর। মনু মিয়া তার স্ত্রী নির্যাতিতা মমতাজ বেগমকে নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সকালে নিজ বাড়ি আনন্দপুর ফিরলেন। মমতাজ বেগম লক্ষ্য করলেন, এতদিন যারা তাকে আদর করত, ডাক খোঁজ নিত, তারা এখন দূর থেকে তাকে আড় চোখে দেখে। কেউবা তাকে সান্তনার নামে খোঁচা দিয়ে কথা বলে, তার চাপিয়ে রাখা কষ্টকে উসকে দেয়। তবে সান্তনা এ যে, স্বামীর ঘরের কেউ-ই তাকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দায়ী করে নি। বরং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে।

মমতাজ বেগম আরো বলেন, ৭১ সালের এ দুঃখজনক ঘটনার কারণে কখনো বেশী মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। স্বজনদের নানা অনুষ্ঠানে যাই নি। যদি কখনো তারা এ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন করে। কত নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যে গত ৪৪ বছর বেঁচে ছিলাম তা কাউকে বুঝাতে পারব না। তবে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে নানা সাহায্য সহযোগিতা করছে। সে জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখের বেটি শেখ হাসিনার জন্য দু’হাত দোয়া করি। এবার জেলা প্রশাসন কুমিল্লায় অনুষ্ঠান করে আমার মত আরো ১৪/১৫ জনকে সরকারী খাস জমি দিয়েছে।

স্বামী মনু মিয়া বললেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করায় যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছি এ দেশের মানুষদের আচরণে, যারা সুযোগ পেলেই এ প্রসঙ্গটি এনে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলত। আমাকে অনেকে কটু কথা বলত। আমি কোন দিন তা মনে নেইনি। শুধু বলেছি, আমার স্ত্রীর কোন দোষ নেই। আমার স্ত্রী দেশের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন এটাই আমার কাছে গর্বের বিষয়।

Advertisement
Share.

Leave A Reply