সেতু হলো নির্মাণের অন্যতম একটি শিল্পকলা। এসব স্থাপনা মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। এই ধরনের স্থাপনা এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডের মানুষকে সংযুক্ত করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে। স্থাপত্যবিদ্যার আর্শীবাদে ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে, তার মাঝে নির্মাণশৈলীর এক অপরুপ নিদর্শন হলো সেতু।
বাঙালির বহু আকাংক্ষিত পদ্মা সেতু। কত না স্বপ্ন এই পদ্মা সেতু নিয়ে! সেই স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয়ে সংযুক্ত হলো পদ্মার দু’পাড়। বসলো গর্বের সেতুর শেষ কাঠামো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের এই সেতুই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতুর কথা তো হলো। এবার আসুন জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতুগুলোর কথা।
পৃথিবীতে দীর্ঘতম সেতুর আলোচনা হলে তাতে এগিয়ে থাকবে চীন ও এশিয়া। কারণ, দীর্ঘতম ১০টি সেতুর মধ্যে চীনের নির্মিত সেতুই রয়েছে ৭টি! আর সেরা ১০টির মধ্যে ৯টিই হলো এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত। মজার ব্যাপার হলো, একমাত্র যে সেতুটি এশিয়ার বাইরে সেটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো দীর্ঘতম সেতু। তৈরি হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। অর্থাৎ এই সেতুর তালিকা দিয়েই বোঝা যায়, এশিয়া মহাদেশ প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি ও স্থাপত্যশৈলীতে কতটা এগিয়ে যাচ্ছে। চলুন দেখে নেই বিশ্বের দীর্ঘতম ১০টি সেতুর তালিকায় কোনগুলো রয়েছে…
১. ড্যানইয়াং কুনসান গ্র্যান্ড ব্রিজ
বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ডের রেকর্ডসে নাম রয়েছে চীনের ড্যানইয়াং কুনসান গ্র্যান্ড ব্রিজের। ২০০৬ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ৪ বছর পর ২০১০ সালে তা শেষ হয়। ১শ’ ৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর কাজ শেষ হওয়ার এক বছর পর ২০১১ সালে এর রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেতুটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। দীর্ঘতম এই সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২. তিয়ানজিন গ্র্যান্ড ব্রিজ
২০০৬ সালে বেইজিং-সাংহাই হাই স্পিড রেলওয়ের অংশ হিসেবে তিয়ানজিন গ্র্যান্ড ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১শ’ ১৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি পাঁচ বছর পর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পৃথিবীর সর্বপ্রথম সেতু হিসেবে এটি ১শ’ কিলোমিটারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
৩. উইনান উইহে গ্র্যান্ড ব্রিজ
চীনের জাংঝো জিয়ান রেলপথের অংশ হলো উইনান উইহে গ্র্যান্ড ব্রিজটি। ২০০৮ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলেও তা জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০১০ সালে। ৭৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি ছিল সেসময়ে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু।
৪. ব্যাং না এক্সপ্রেস
ব্যাং না এক্সপ্রেস হলো থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু। ২০০০ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়, যা ‘বুরাফি উইট এক্সপ্রেস’ নামে পরিচিত। ২৭ মিটার প্রশস্তের সেতুটিতে রয়েছে ৬টি লেন। সেতুটি কোনো বিশাল নদীর উপরে স্থাপিত নয়। বরং সেতুর একদম ছোট্ট একটা অংশের নিচ দিয়ে ছোট একটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এটি আমেরিকা ও এশিয়ার যৌথ বিনিয়োগে নির্মাণ করা হয়।
৫.বেইজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ
চীনের বেশিরভাগ দীর্ঘ সেতুগুলো মূলত রেলপথ। আর বেইজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ রেলসেতুটি বেইজিং-সাংহাই হাই স্পিড রেলওয়ের অংশ। ২০১০ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে ২০১১ সালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম সেতু এটি, যার দৈর্ঘ্য ৪৮ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এই সেতুতে ঘন্টায় ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারে।
৬. লেক পঞ্চারট্রেন কজওয়ে ব্রিজ
পৃথিবীর দীর্ঘতম ১০টি সেতুর তালিকার ৯টিই এশিয়ার মধ্যে, আর এশিয়ার বাইরে ১টি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। তা হলো লেক পঞ্চারট্রেন কজওয়ে ব্রিজটি। আমেরিকার সর্ববৃহৎ এই সেতুটি লুজিয়ানায় অবস্থিত। সেতুটি নির্মাণ করা হয় দুই দফায়। ১৯৫৬ সালে নির্মাণ করা হয় এর দক্ষিণঅংশ, আর উত্তর অংশ নির্মাণ করা হয় ১৯৬৯ সালে। সেতুটি ৩৮ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ।
৭. ম্যানচ্যাক সোয়াম্প ব্রিজ
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম সেতু হলো ম্যানচ্যাক সোয়াম্প ব্রিজ। ৩৬ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার এই সেতুটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯৭৯ সালে। সম্পূর্ণ টোল ফ্রি এই সেতুটি নির্মাণ করতে মাইল প্রতি খরচ হয়েছে ৭ মিলিয়ন ডলার।
৮. ইয়াংকুন ব্রিজ
ইয়াংকুন ব্রিজটি নির্মাণ করা হয় বেইজিং-তিয়ানজিন আন্তঃরেল যোগাযোগের জন্য। ৩৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুতে ঘণ্টায় ৩শ’ ৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারে। ২০০৭ সালে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার পর সেতুটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
৯. হ্যাংঝৌ বে ব্রিজ
চীনে অবস্থিত ৯ম বৃহত্তম দীর্ঘ সেতু হলো হ্যাংঝৌ বে ব্রিজ। চীনের জিয়াঝিং ও নিংবো শহরকে এই সেতুটি জেঝিয়াং প্রদেশের সাথে যুক্ত করেছে। ৩৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটি নির্মাণে ১১.৮ বিলিয়ন ইয়ান খরচ হয়েছে। সেতুটির নির্মাণকাজ ২০০৭ সালে শেষ হলেও তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে ২০০৮ সালে।
১০. রানইয়াং ব্রিজ
রানইয়াং ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে চীনের ইয়াংজি নদীর উপরে। জেনজিয়াং প্রদেশের সাথে ইয়াংহো প্রদেশকে যুক্ত করেছে এই সেতুটি। সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০০০ সালে শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২০০৫ সালে।
একেকটি সেতু কেবল একেকটি জনপদকেই না, সহজ করে মানুষের জীবন-যাপন, বাঁচায় মানুষের মূল্যবান সময়।