২১ মে কণ্ঠশিল্পী ন্যানসির ছোট মেয়ে আলিনার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। মেয়েকে নিয়ে লেখা ন্যানসির একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করা হলো বিবিএস বাংলার পাঠকের জন্য।
১০ মে ২০১৬
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আমি ন্যানসি বলছি।
-কে?
(মনে পড়ে গেল এখন আর আমি ন্যানসি নই। আমার এখন নতুন পরিচয়)
– আমি NICU-10 এর মা বলছি।
(অপর প্রান্তে নীরবতা। কিছুক্ষণ পরে নতুন একটি কণ্ঠ মোলায়েম স্বরে…জি আপু বলেন।)
NICU-10, আসল নাম আলিনা জাফরিন। আমার তৃতীয় কন্যা সন্তান। ‘সেপটিসেমিয়া’ তে আক্রান্ত। গতকাল ওকে এই হাসপাতালের NICU তে ভর্তি করা হয়েছে। কতদিন থাকবে জানি না। দিনে কয়েকবার গিয়ে ওকে দেখে আসি। আমার মেয়েটা বেশিরভাগ সময় চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর শুধু কাঁদে। আমি নীরবে তাকিয়ে শুধু দেখি।
১১ মে ২০১৬
আজ রাত ১০ টায় আলিনার প্রথম অপারেশন হবে। ওর পরিপাকতন্ত্রের কিছুটা অংশে ইনফেকশন এর জন্য পঁচন ধরেছে। ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আক্রান্ত অংশটুকু কেটে ফেলে দেবেন। বাচ্চার সারভাইভ করার চান্স ৭০%। আমরা একসাথে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর OT-এর ভেতর থেকে একজন জায়েদকে ভেতরে ডেকে নিলেন। জায়েদ বের হওার পর জানলাম আলিনার পেটের ভেতরের পঁচনটা দেখানোর জন্য ওকে ডাকা হয়েছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর অপরেশন সফলভাবে শেষ হল। আমরা আল্লাহ্র কাছে শোকরিয়া আদায় করে বাড়ি ফিরলাম।
১২মে ২০১৬
আলিনার নাকের ভেতর নল,মাথায় ক্যানোলা, হাতে ক্যানোলা , পেটে বড় একটা ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজের পাশে মলমূত্র বের হবার জন্য একটা ড্রেন (আলিনার পেটের ভেতরের যে অংশটুকু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটা আর জোড়া দেওয়া হয়নি। সব কিছু যদি ঠিক থাকে, তাহলে দেড় মাস পরে আরেকটা অপারেশন করে ড্রেনটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তত দিন পর্যন্ত পেটের পাশের ড্রেন দিয়েই মলমূত্র বের হবে), পায়ে ক্লিপ আটকানো, বুকে একটা নল স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। ও কেঁদেই যাচ্ছে, যথারীতি আমিও দেখছি। মাঝে মাঝে ওর মাথায়, হাতে, পায়ে হাত বুলাচ্ছি।
১৫মে ২০১৬
আলিনার শরীরের অবস্থা হঠাৎ করেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেডিসিন দিয়ে ওর ইনফেকশন সরানো যাচ্ছে না। ওর চোখ বন্ধ, আমি ওর চোখ খোলার আশায়…।
১৬মে ২০১৬
আলিনা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। আমি ওর পিঠে চাপড় দিচ্ছি, হাত ঝাকাচ্ছি, চোখের উপর হাত বুলাচ্ছি, মা মা করে ডাকছি, তবুও ও চোখ খুলছে না।
১৮মে ২০১৬
সকাল ৯ টা। NICU তে ফোন করে জানলাম, আজ আলিনার মুখে খাবার দেওয়া হবে। আমি আর জায়েদ আনন্দে আত্মহারা। তাড়াতাড়ি ফিডারে দুধ ভরে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে।
আলিনার সামনে চেয়ারে বসে আছি। ওর মুখে খাবার দেওয়া হয়নি। দায়িত্বরত ডাক্তাররা পেডিয়াট্রিক সার্জন এর জন্য অপেক্ষা করছেন। কী করতে হবে তা উনি এসে বলবেন। ঘড়িতে তিনটা পনের, আলিনার ব্যান্ডেজের ফাক দিয়ে সবুজ পানি বের হচ্ছে। সবুজ পানিটা যে দিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানকার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে (এসিডে পুড়লে যেমন ঝলসে যায়, সেরকম)। আমি নিচে নেমে আসলাম। আমি যখন NICU এর ভেতরে থাকি, তখন জায়েদ বাইরে অপেক্ষা করে। বের হয়ে ওকে বললাম, ডাক্তার কখন আসে জানি না, চল চলে যাই। ও যেতে রাজি না। একটু পর ডাক্তার আসলেন। আলিনার ব্যান্ডেজ খোলা হল। পেটের যে অংশটুকু সেলাই করা হয়েছিল তার অনেকটাই ঝলসে গিয়ে সেলাই খুলে যাওয়ার উপক্রম।
৪.৩০ বাজে। OT এর ভেতর আলিনা, বাইরে আমরা। এবার সারভাইভ করার সম্ভাবনা ৫০% এরও কম। আবার OT এর ভেতর থেকে জায়েদের ডাক পড়ল। ও তখন রক্ত দিতে গিয়েছে। ভেতরে আমি গেলাম। ডাক্তার আলিনার পেটের ভেতরটা দেখালেন। আমি মনোযোগ দিয়া দেখলাম নাড়ির কতটুকু পচে গেছে, কতটুকু কেটে বাদ দিবে। বাইরে এসে অপেক্ষার পালা। এবারও অপরেশন সফল হল। আমরা এক বুক আশা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
১৯মে ২০১৬
আলিনার চোখ খোলা, আমি নিস্পলক। তখনো জানতাম না শেষবারের মতো দুজন দুজনকে দেখছি।
২০মে ২০১৬
আলিনার যে কোন সময় ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হতে পারে। ডাক্তার ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাচ্ছেন মেশিন এর সাপোর্ট দিবেন কি দিবেন না। জায়েদ ডাক্তার কে বলল, যা যা দরকার, সব করেন, শুধু আমাদেরকে ফোন দিয়ে জানাবেন।
রাতে আলিনাকে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (সাদা রক্ত) দেয়া হল। এই কয়েক দিনে আলিনাকে বেশ কয়েক দফায় ফ্রেশ রক্ত ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা দেয়া হয়েছে। জায়েদ শেষবারের মত মেয়েকে চোখ খোলা দেখলো। রাতে হাসপাতালে না যাবার কারণে আমার আর দেখা হল না।
২১মে ২০১৬
সকাল ৮.৩০। আলিনার হার্টবিট রেট ক্রমশ কমছে। বুকের পাঁজরের হারগুলো কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে উঠা নামা করছে। চোখের পাতা একটু খোলা, মনে হচ্ছে যেন চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছে। আমি ওকে কোলে নিতে চাইলাম। আজ আর কেউ বাধা দিল না। কতক্ষণ পর ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল আলিনা মারা গেছে। জায়েদ আমার কাঁধে হাত রেখেছে। আজ আর ওর স্পর্শে ভরসা পাচ্ছি না। মৃত্যুর পরও আলিনার বুকের হাড় কৃত্রিমভাবে ওঠা নামা করছে।
আলিনার শরীর থেকে সমস্ত নল খুলে নেওয়া হল। এবার ওর সমস্ত শরীর কচি কলাপাতা রঙের পাতলা পেপার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হল। শুধু ছোট্ট মুখটা বের হয়ে আছে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চিৎকার করে বলছি… আমি সঙ্গীতশিল্পী ন্যানসি নই, আমি NICU-10 এর মা নই, আমি এই ছোট্ট শিশুটির মা যার নাম আলিনা জাফরিন। ওর বয়স ১৭ দিন। কেউ কি ওকে আমার বুকে ফিরিয়ে দেবেন…? আল্লাহ, তুমি কি দয়া করে ওর হায়াত বাড়িয়ে দেবে? কেউ কি আছেন যে এই নিষ্পাপ বাচ্চার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করবেন। হয়তো আপনাদের দোয়ায় আল্লাহ্ ওর প্রাণ ভিক্ষা দেবেন… কেউ আমার চিৎকার শুনতে পাচ্ছে না।
২২ মে ২০১৬
সকাল ৯.৩০। সব আবার আগের মতো। আলিনার বিছানা, বালিশ, কাঁথা, টাওয়েল, দোলনা, খেলনা, জামা সব গোছানো। আলিনার জামা থেকে এখনো ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। আমাকে আর প্রতিদিন হাসপাতালে যেতে হয় না, ফোন দিয়ে বলতে হয় না আমি NICU-10 এর মা বলছি। আমি এখন আলিনা জাফরিন এর মা।