fbpx

বদরুদ্দীন উমরের আরোগ্য কামনা

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর। তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া হানমও এ ভাইরাসে আক্রান্ত। এখন এ দম্পতি চিকিৎসাধীন রাজধানীর একটি হাসপাতালে। সস্ত্রীক বদরুদ্দীন উমরের আরোগ্য কামনা করে গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন বিবিএস বাংলা’র মতামত বিভাগে।

বদরুদ্দীন উমর ও তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া হানমের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া খবরটা শুনে উদ্বিগ্ন হয়েছি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বদরুদ্দীন উমর অন্যতম একজন মহীরূহ। এখন তাঁর বয়স বয়স ৮৯ বছর। বদরুদ্দীন উমরের দীর্ঘ এবং সক্রিয় জীবন কামনা করি।

ভাষা আন্দোলন বিষয়ক ইতিহাস রচনা বদরুদ্দীন উমরের অমরকীর্তি। বাংলার ইতিহাস বিষয়ে তাঁর কাজগুলো তুলনাহীন, বিশেষ করে ‘বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ গ্রন্থে তিনি আমাদের দেশে প্রাধান্যশীল কংগ্রেসী ইতিহাসের লুকানো সাম্প্রদায়িক চেহারাটাকে খুব স্পষ্ট করে সামনে এনেছেন, ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত কাজ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ এই বিষয়ে আলোচনার ভিত্তি নির্মাণ করেছিলো, এখনও সে কাজ সন্দেহাতীতভাবেই অত্যন্ত শক্তিশালী। তাঁর মূল্যায়নের সাথে কিছু ভিন্নমত থাকলেও এই কাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে দ্বিধা বা সংশয়ের কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু তাঁর কম আলোচিত কাজগুলো নিয়ে কিছুটা বলা যাক, সেগুলো কম আলোচনায় আসে, কারণ এদেশে রাজনীতির আলোচনা ও পাঠ সর্বদাই দুর্বল।

আমার কাছে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে হয়- বাংলাদেশে মার্কসবাদের চর্চা ও প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে আলোচনাগুলোকে। মুখস্ত বিদ্যার বদলে বাস্তব প্রেক্ষিতগুলোকে বুঝবার চেষ্টাটা তাঁর সেই কাজগুলোর মাঝে প্রবল। তাঁর বিশ্লেষণের সঠিকতা, অসম্পূর্ণতা ইত্যাদি নিয়ে ভিন্নমত থাকুক, এটা জোর দিয়ে বলতে পারি তিনি মস্কো/পিকিং/দিল্লি/কলকাতার হুকুমদারির বাইরে স্থানিক বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নেয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। অধস্তন মনোবৃত্তিটা তাঁর ছিল না, যেটা তাঁর তরুণ বয়স থেকে আজকের সময়কার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য।

তাঁর আরও একটি অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে যারা জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদী পন্থায় বিপ্লব সম্পন্ন করতে চেয়েছেন, এবং এর জন্য ষাট দশকে গড়ে ওঠা বিপুলাকায় ছাত্র সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে পরিত্যাগ করে, বল প্রয়োগকে তার সংকীর্ণতম সংজ্ঞায় সীমিত করে বিপ্লবী রাজনীতিকে অন্ধকানাগলিতে নিয়ে গিয়েছেন, তাদের সাহস আর অবদানটুকু স্বীকার করেও বাংলাদেশের রাজনীতিকে তারা যে কতদূর পিছিয়ে দিয়েছেন, সেটার সবচাইতে প্রভাবশালী সমালোচনা ও পর্যালোচনাগুলো বদরুদ্দীন উমরের হাত ধরেই এসেছে।

বলা প্রয়োজন, এর বিপরীতে গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতায় রাষ্ট্র ও সমাজ বদলের একটা উপায় হিসেবে, পুরনোর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পদ্ধতি হিসেবে স্থাপনের কৃতিত্বও বদরুদ্দীন উমরের।

আর একটা বিষয় নিয়ে আলোচনাও প্রায় হয় না, কিন্তু আমি সেখানে খুব গুরুত্ব দেই। বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশ বলে যা কিছু বুঝি, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত উৎস হিসেবে তার একটা ছোট প্রবন্ধকে ঘোষণা করতে পারি, সেটার নাম ভুমি-সংস্কার প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আলাপে ভুমি প্রায় উহ্য থাকে, মনে হয় একটা পার্শ্বস্থ কিছু, মূল আলাপের সাথে ভাবা যাবে। কিন্তু সেই আলাপটাই যে মূল আলাপ, এমনকি রাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্র যদি ঢাকাও হয়, সে সাম্রাজ্যবাদের কবলিত ঢাকা না জাতীয় বিকাশের পথে অগ্রসর হতে থাকা বিকেন্দ্রিত হতে থাকা ঢাকা, সেটা নির্ভর করে ওই ভুমিকেন্দ্রিক কর্মসূচিতে, এমনকি শ্রমিকের জন্য, নগরবাসী মধ্যবিত্তের জন্য তার মূলভাবটার সম্প্রসারণে।
রাজনীতি ও অর্থনীতির চিন্তা যখন বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় সজ্ঞানে কিংবা মনের অজান্তেই তাকে আমরা একমাত্র উপায় বলে গণ্য করি, তখন স্থানিক বৈশিষ্ট্য, ভুমিসম্পর্ক এবং অন্য বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যায়। আমাদের না শুধু, প্রায় সকল পরাধীন/পরিযায়ী শাসকদের অধীনে থাকা দেশেই তা ঘটেছে। চিন্তার ভিত্তিটাকে নিজের সময়ে, নিজের ভুমিতে স্থাপন করার গুরুত্বটা, অন্তত চেষ্টাটা বদরুদ্দীন উমরের কাছ থেকেই শিখেছি। সেই চেষ্টার বাস্তবায়নে যদি কিছুটা দূরত্বও তৈরি হয় স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরের সাথেই, সেই কৃতিত্ব তাকে দিতে কোনো কুণ্ঠা নেই।

সবশেষে আবারও আজীবন লড়াকু উমর ভাই ও সুরাইয়া ভাবীর আশু আরোগ্য কামনা করছি।

 

Advertisement
Share.

Leave A Reply