পরাগ আহমেদ। বন্ধু মহলে সে ‘ভবঘুরে পরাগ’ নামেই বেশি পরিচিত। যেমন নাম, কাজও কিন্তু ঠিক তেমনই। ঘুরতে ভালোবাসেন, মানুষকে ঘোরাতেও। পড়াশোনা শেষ করে তাই এই ঘোরাফেরাকেই জীবনের মূল উপজীব্য করে নিয়েছেন।
নিজের ৮-১০ বছর ঘোরার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে খুলেছেন ‘ভবঘুরে’ নামের এক ট্রাভেল এজেন্সি। এখানেই থেমে যাননি। ‘রঙের খেয়া’ নামের একটি ট্রলারও কিনেছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন সেইন্টমার্টিন আইল্যান্ডে ‘দ্যা বিচ ক্যাম্প’ রিসোর্ট গড়ে তোলার মাধ্যমে। নিজের অধীনে ১০ জন কর্মী নিয়ে কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তবে করোনার কারণে সব কিছু ভেস্তে গেছে। প্রথম দফার লকডাউনের ক্ষতি না পুষিয়ে উঠতেই আবারও দেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত যারা, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে করেন পরাগ।
বলেন, সবাই যদি ঘরে থাকে আমরা যারা রিসোর্ট বানিয়েছি তাদের রিসোর্টে থাকবে কারা? এই খাতে যেমন ব্যবসা জড়িত, তেমনি পর্যটন উন্নয়নও জড়িত।
তিনি আরও বলেন, করোনার এই সময়ে আমরা যারা এই রিসোর্ট ও ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গভাবে জড়িত, তাদের জীবন স্থির হয়ে আছে। সকল কিছু বন্ধ থাকলেও আমার ওপর নির্ভর করে অনেকের হাঁড়ির ভাত।
সরকার পর্যটন সেক্টর সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখে না। তারা জানেই না যে এ সেক্টরে কত হাজার মানুষ রয়েছে। আসলে মূল কথা হচ্ছে আমরা কিছুই পাচ্ছিনা। আমাদের উপর সরকারের কোন প্রকার দৃষ্টি নেই বলেও অভিযোগ করেন পরাগ।
মানুষ ভ্রমণ না করলে আমাদের উঠে দাঁড়ানোর কোনো উপায় নেই বলেও জানান তিনি। সরকারের উচিত স্বল্প পরিসরে হলেও পর্যটন লোকেশন খুলে দেয়া। আর যদি সেটা একেবারেই সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম এর মাধ্যমে এই সেক্টরে যারা কাজ করছেন তাদের জন্যে আর্থিক একটা বাজেট রাখা। সকল কিছুর মধ্যে পর্যটন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা আগে সরকারের মাথায় ঢুকাতে হবে।
মাত্র কয়েক মাস হলো দেশের হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। গত বছর দেশজুড়ে প্রথম লকডাউনের পর মানুষ এক রকম হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। মহামারির কারণে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের ভেতরই নিঃশ্বাস নিতে রিসোর্টে ছুটে যান ভ্রমণপিপাসুরা।
মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রিসোর্টের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অতিথিদের দ্বারা পূর্ণ থাকত। ক্লান্ত নগরবাসী হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে রিসোর্ট কেন্দ্রিক ভ্রমণের পরিকল্পনা সাজাতেন।
গত বছর ৩১ মে সাধারণ ছুটি শেষ হলে রিসোর্টগুলো খুলতে শুরু করে। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী, তারা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
তবে, সব পরিকল্পনাই এবার ভেস্তে গেছে। সপ্তাহব্যাপী লকডাউনে রিসোর্টগুলোতে এ মাসের অন্তত ২৫ শতাংশ অগ্রীম বুকিং বাতিল করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির সাজেকে অবস্থিত মেঘরাজ রিসোর্টের মালিক আহসান আলী। খাগড়াছড়িতে তার মাদল ইকো নামের আরেকটি রিসোর্ট রয়েছে। শুধু তাই নয়, বান্দরবানের নীলগিরিতে গড়ে তুলেছেন ক্যাফে নীল এন্ড রিসোর্ট। করোনা আর লকডাউনে তার ব্যবসায় নেমে এসেছে কালো মেঘের ছায়া।
তিনি বলেন, আমাদের মোটামুটি রোজার আগ পর্যন্ত ৭০ শতাংশ বুকিং ছিল। কিন্ত সরকারের ঘোষিত লকডাউনে আমরা সবাইকে তাদের অ্যাডভান্স মানি ফেরত দিয়েছি। এটি আমাদের জন্য বিশাল আর্থিক ক্ষতি। আমাদের আসলে এখানে কিছুই করার নেই।
আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার মাঝে প্রায় আট মাসে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মতো। এই ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই আবারও লকডাউনের কবলে পড়লো সারা দেশ।
আমার এই ব্যবসার সাথে আরও অনেক মানুষের রুটি রুজি জড়িয়ে আছে। তিনটি রিসোর্টে আমার অধীনে মোট ৩২ জন মানুষ কাজ করে। এখন আয় না থাকলেও নিজের পকেট থেকে হলেও আমার কর্মীদের বেতনটা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান আহসান।
তিনি আরও বলেন, সরকার পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করলেও এই খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। আমরা সরকার, ব্যাংক বা অন্য কোথাও থেকে তেমন কোনো সুবিধাও পাই না। এই লকডাউনে সরকার যদি আমাদের দিকে তাকাতো, আমরা তাহলে আমাদের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতাম।
আমরা চাই, সরকার এবারের বাজেটে পর্যটন খাতে প্রণোদনা ঘোষণা করুক। এই খাত যেনো তলিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ আমরা আশা করছি বলেও জানান এই রিসোর্ট মালিক।