তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ কাজই এখন মোবাইলের মাধ্যমে করা সম্ভব। যেমন- এখন যে কেউই ঘরে বসে বিদ্যুৎ বিল, ওয়াসার বিল, গ্যাস বিলসহ সব ধরনের বিল দিতে পারবেন।
শুধু তাই নয়, এখন আর বাস বা ট্রেনের টিকট কাটতে আপনাকে সেই স্টেশনে দৌড়াতে হবে না। মুহূর্তেই ঘরে বসে কাটতে পারবেন টিকিট।
এমনকি এখন আর পাসপোর্ট করতে আপনাকে দৌড়াতে হবে না পাসপোর্ট অফিসে। আর সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনেও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। এছাড়া দালালদের কথা তো বাদই দিলাম। সেই খপ্পরেও আপনাকে পড়তে হচ্ছে না।
ঘরে বসে অনলাইনে আপনি যে কোনো স্থান থেকে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে সবার আগে আপনাকে জানতে হবে ই-পাসপোর্ট কী এবং এতে আপনি কী বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন।
ই-পাসপোর্ট
২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ১১৯ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। এটি এমন একটি বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট যেখানে একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক চিপ রয়েছে। এ চিপের মাধ্যমে পাসপোর্টধারীর পরিচয় প্রমাণ করা যায়। এছাড়া এতে রয়েছে মাইক্রোপ্রসেসর বা চিপ এবং অ্যান্টেনাসহ স্মার্টকার্ড প্রযুক্তি। আর পাসপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই চিপে সংরক্ষণ করা হয়।
ই-পাসপোর্টে ছবি, আঙ্গুলের ছাপ (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) ও আইরিশ বায়োমেট্রিক তথ্য হিসেবে নেয়া হয়। ইলেকট্রনিক বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থা (ই-বর্ডার) দিয়ে পাসপোর্ট চিপের বাইরের বায়োমেট্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করা হয়। আর পাসপোর্ট জালিয়াতি ঠেকাতে পাবলিক কি ইনফ্রাষ্ট্রাকচারের (পিকেআই) মাধ্যমে চিপে থাকা তথ্য যাচাই করা হয়।
সাধারণ পাসপোর্ট থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে, এতে মোবাইল ফোনের সিমের মতো ছোট ও পাতলা আকারের চিপ থাকে। যেখানে ৩৮ ধরনের নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য থাকবে।
এই পাসপোর্টও ম্যানুয়েল পাসপোর্টের মতো অনলাইনে পাওয়া যাবে। আবার চাইলে ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে হাতেও ফরম পূরণ করতে পারবেন। তবে ছবি সত্যায়ন করা লাগবে না।
আর পাসপোর্ট করতে ইচ্ছুক এমন নাগরিককে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে জন্মসনদ জমা দিতে হবে। আবেদনপত্র জমা দিতে গেলে তখন তার ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের ছবি নেয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে সব তথ্য সেই চিপে জমা হবে। আর যখন ইমিগ্রেশন পুলিশ বিশেষ যন্ত্রের সামনে পাসপোর্টের পাতাটি ধরবে, সঙ্গে সঙ্গে সব তথ্যই বেরিয়ে আসবে।
এই ই-পাসপোর্ট দুই ধরনের। একটি ৪৮ পাতার আর বাকিটি ৬৪ পাতার। তিন ধরনের ফি দিয়ে এই পাসপোর্ট সংগ্রহ করা যাবে। যেমন- সাধারণ, জরুরি এবং অতি জরুরি।
আপাতত রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও আগারগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট গ্রহণ করা যাবে। ধীরে ধীরে দেশের ৭২টি আঞ্চলিক ও বিভাগীয় অফিস থেকে ও এটি গ্রহণ করা যাবে।
আবেদন করবেন যেভাবে
প্রথমে আপনাকে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখানে আপনি বাংলা বা ইংরেজি ভাষা বেছে নিতে পারবেন।
পরের ধাপে আপনি দুটো অপশন দেখতে পাবেন। নতুন/ রি-ইস্যু। এখানে ক্লিক করে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
তবে এর আগে ই-পাসপোর্ট আবেদনের ৫টি (পাঁচ) ধাপ আপনি চাইলে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। ধাপগুলো হচ্ছে- বর্তমান বসবাসরত জেলাতে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে কি না, অনলাইনে ই-পাসপোর্ট আবেদন ফরম,পাসপোর্ট ফি পরিশোধ, ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ ও পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট সংগ্রহ।
তবে কাগজপত্র ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই, আবেদনকারীর ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ ও আইরিশের ছবি গ্রহণ, যথাযথভাবে পাসপোর্ট ফি পরিশোধ হয়েছে কি না এবং তালিকাভুক্তির পর সরবরাহ করা ডেলিভারি স্লিপ সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না, এগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
আর পাসপোর্ট নেয়ার সময় আপনি কিন্ত ডেলিভারির রসিদ নিতে একদম ভুলবেন না। আর যদি সর্বশেষ পুরোনো পাসপোর্ট থাকে, সেটিও সঙ্গে রাখতে হবে।
ই-পাসপোর্ট আবেদন অনলাইনে দাখিল করার সময়ে পাসপোর্ট ফিও পরিশোধ করা যাবে। এই ফি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব করা হবে।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিসের আবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে অনলাইনে পেমেন্ট করা যাবে। এছাড়া সোনালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ঢাকা ব্যাংকে পাসপোর্টের টাকা জমা দেয়া যাবে।
গেটওয়ের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের পেমেন্ট অনলাইন পেমেন্ট দেওয়া হয় এবং স্টারকার্ড, ভিসা, কিউ-ক্যাশ, বিকাশ ও ডিবিবিএল নেক্সাস পের মাধ্যমেও পাসপোর্টের ফি জমা দেয়া যায়। আর অনলাইনে পেমেন্ট করার জন্য ব্রাউজারের পপ-আপ ব্লকার অক্ষম করতে হবে।
ফি
ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদের জন্য ই- পাসপোর্টের ফি আলাদা। সাধারণত ৫ বছর মেয়াদি ২১ দিনের নিয়মিত সরবরাহ ৪ হাজার ২৫ টাকা, ১০ দিনের দ্রুত সরবরাহ ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, ২ দিনে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি ৮ হাজার ৬২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর ৪৮ পৃষ্ঠা ১০ বছর মেয়াদি ২১ দিন ডেলিভারি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ১০ দিনের ডেলিভারি ৮ হাজার ৫০ টাকা ও ২ দিনের ডেলিভারি ১০ হাজার ৩৫০ টাকা ধরেছে সরকার।
এছাড়া ৬৪ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদি ২১ দিনের ডেলিভারি ৬ হাজার ৩২৫, ১০ দিনের ডেলিভারি ৮ হাজার ৬২৫, ২ দিনের ডেলিভারি ১২ হাজার ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৬৪ পৃষ্ঠা ১০ বছর মেয়াদি ২১ দিনের ডেলিভারি ৮ হাজার ৫০, ১০ দিনের ডেলিভারি ১০ হাজার ৩৫০, ২ দিনের ডেলিভারি ১৩ হাজার ৮০০ টাকা ধরা হয়েছে।
এই পাসপোর্ট কেন নেবেন?
এই পাসপোর্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এর মাধ্যমে ই-গেট ব্যবহার করে সহজেই ভ্রমণকারীরা যাতায়াত করতে পারবেন। ফলে আলাদা করে এয়ারপোর্টে ভিসা চেকিংয়ের লাইনে দাঁড়াতে হবে না। ফলে খুব দ্রুতই ইমিগ্রেশন হয়ে যাবে।
এই পাসপোর্ট নিয়ে ই-গেটের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়ালে তখন ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তুলবে। সেখানে আঙ্গুলের ছাপও যাচাই করা হবে। যদি সব মিলে যায়, তাহলে পাসপোর্টধারী সহজেই ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতে পারবেন। আর কোনো তথ্য না মিললে সঙ্গে সঙ্গে লালবাতি জ্বলে উঠবে। এছাড়া যদি কারো ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সেটিও জানা যাবে।
বিশেষ নজর
ই-পাসপোর্টের আবেদনপত্র জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী পূরণ করতে হবে। আর যাদের বয়স ১৮ বছরের কম বা যার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তার পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
অনলাইনে অথবা পিডিএফ ফরমেট ডাউনলোড করে এই ফরম পূরণ করা যাবে। সেখানে কোনো ছবি এবং কোনো ধরনের কাগজপত্র সত্যায়নের প্রয়োজন নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এনআইডি এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদপত্রসহ বাবা-মায়ের এনআইডির কপি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আবেদনপত্র জমা নেয়ার সময় হাতের ১০ আঙুলের ছাপ, ছবি ও চোখের আইরিশ ফিচার নেয়া হবে। তবে ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হবে। আর অতি জরুরি ক্ষেত্রে ই-পাসপোর্ট করার জন্য প্রি-পুলিশ ভেরিফিকেশন নিজ উদ্যোগে করে নিয়ে যেতে হবে।
ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ভিসার বিষয়টিও একই থাকবে। ভিসা কর্তৃপক্ষ বা দূতাবাসগুলো এই পিকেডি ব্যবহার করে আবেদনকারীর তথ্য যাচাই করে নিতে পারবে। তারা বইয়ের পাতায় ভিসা স্টিকার, সিল দিতে পারবে বা বাতিল করে দিতে পারবে।
এছাড়া এমআরপিও চালু থাকবে। তবে নতুন করে কেউ এমআরপি নিতে পারবেন না। পর্যায়ক্রমে সব এমআরপি তুলে নেওয়া হবে। আবেদন করার বিস্তারিত নিয়মাবলি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
অনলাইন চেক
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘স্ট্যাটাস চেক’ করে জানা যাবে আপনার পাসপোর্টের আবেদনের বর্তমান অবস্থা এখন কেমন। জন্মতারিখ ও আবেদনের ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে সার্চ করলে বিস্তারিত জানা যাবে। সেখানে নিজের অনলাইন পোর্টাল অ্যাকাউন্ট থেকে আবেদনের সর্বশেষ অগ্রগতি জানা যাবে।