fbpx

তানভীর আল হোসেনের গল্প ‘অপেক্ষা’

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

বৃশ্চিক রাশির জাতক তানভীর আল হোসেনের জন্ম ঢাকায়। পড়েছেন সেনা পল্লী স্কুল ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতক তিনি। ছোটবেলা থেকেই কবিতা, গল্প লেখা আর ছবি তোলার নেশা তার। ২০১১ সালের পর বেশ কিছু ভিজুয়াল ফিকশন নির্মাণ করেন তিনি। ২০২০ সালে বাংলাদেশ সিনেমা এন্ড টেলিভিশন ইনিস্টিটিউট থেকে ডকুমেন্টরি নির্মাণের ওপর পাঠ নেন তানভীর। সিনেমা, চিত্রনাট্য, গল্প, কবিতাসহ সব মাধ্যমেই এখন সক্রিয় এই তরুণ সৃষ্টিশীল।

মানুষটার পুরো নাম ইমরান রুদ্র। ডাকনাম রুদ্র। ৩৫ বছরের অবিবাহিত পুরুষ। অফিস ছুটির পর পার্কের একটা বেঞ্চে রোজ গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। মনে হয় তার চারপাশের কোথাও কোনো বদল হয়নি। রুদ্র ভেবে পায় না, সত্যিই কি কিছুই বদলে যায়নি? একসময় রুদ্র খুব বদলে দেবার স্বপ্ন দেখত। রুদ্র তাকায়। দেখে সোবহান চা বানাচ্ছে। বহু বছর ধরে সোবহান আর তার চা দোকান একইরকম আছে। পুরনো কাঠ আর জং ধরা টিন প্রকট হয়ে দাঁত কেলিয়ে সোবহানের দোকান ঘরে। কিছুই বদলে যায়নি। রুদ্রর পুরনো বটের ঝিমঝিম শীতলতায় হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মনে পড়ে। এই এলোমেলো ভাবনার মাঝে সোবহান চা দিয়ে যায়।

ভার্সিটিতে পড়ার সময় সাথীর সাথে অনেকদুর হাঁটতে হাঁটতে প্রতিদিনই প্রায় একটা সময় সেই পুরনো বটের নিচে এসে আড্ডা হতো তাদের। রুদ্র তখন এক সক্রিয় বাম নেতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রুদ্রের ব্যাচমেট ছিল সাথী। ও রাজনীতি বিষয়ে মাথা না ঘামালেও তাদের আলাপ হতো সমাজ,রাজনীতি নিয়ে।

একবার ক্যাম্পাসে হল দখল নিয়ে গণ্ডগোল লেগে গেল। বেশ কিছুদিন রুদ্র আর সাথীর দেখা হয়নি। আর তাতে সাথীর অনেক অভিমান হয়েছিল। কেঁদেছিলো অনেক। সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা খেয়ে হুশ ফেরা রুদ্র টের পায় চারপাশে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত পায়ে সে মগবাজারের মেসবাসার দিকে যাত্রা করে। এই হলো আমাদের রুদ্র।

অফিস ছুটির পর রুদ্র এক বুধবার সেই পুরনো বটতলার দিকে হাঁটতে শুরু করে। অন্যদিনের মতো সেই পুরনো জায়গার কাছাকাছি আসবার আগেই হাতের বাদাম শেষ হয়। হাতে মুছড়ে ফেলা কাগজের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলতে গিয়েই রুদ্র দেখে দুরে সেই বটের নীচে আজ সাথীর অবয়বের মতো কেউ একজন মাথা নীচু করে বসে আছে। কেমন বিভ্রমের মতো এগুতে থাকে সে। কাছে এসে দেখে.. সাথীই তো! রুদ্র ভুলে যায় আজ কী বার…আজ মাসের কয় তারিখ? সাথীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোনো ভণিতা ছাড়াই সে একটু উচু স্বরেই একটানা বলে যেতে থাকে- তুমি? এখানে? সাথী কোনো উত্তর দেয় না। বরং খুব শান্ত স্বরে বলে তুমি এখানে রোজ আসো, তাই না? রুদ্র তাকায়, তার মনে হয় এ কেমন প্রশ্ন? এই বটগাছটাই তো তার আপনজন।

সাথী বিয়ের দিন মাকে হারিয়ে তার তো কেউ কোথাও ছিল না। একলা জীবনে রুদ্র সরে এসেছে রাজনীতি থেকে, লোকজন থেকে। কেবল এই গাছটাই তো তাকে আপন করে নিয়েছিল। কোনো প্রশ্ন ছাড়া, কোনো হাহুতাশ বা করুণা ছাড়া এমনকি কোনো বিষন্ন উক্তি ছাড়া! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করে দুই নির্বাক নারী পুরুষকে ঘিরে। ঝিম ধরানো সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সাথীই বলে উঠে ‘এখন যাবো…’। রুদ্র আর সাথী আবার ফিরবার পথ ধরে।

ফরিদপুরের মেয়ে সাথী জীবনে বহুদিন পর আজ তার নিজের মন যা চেয়েছে সে কাজই করছে। বাবা, মা নেই এমন মেয়ের বিয়ে দিতে হাজারো অভিভাবক থাকে। পড়াশুনার পাঠ না চুকাতে দিয়েই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে মামা’রা। মা তখন জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে নি:শেষ অবস্থায়। বিয়ের পর জীবনের কোনো ঘ্রাণ আজ অবধি পায়নি সাথী, না প্রেম অথবা অপ্রেম। সন্দেহের গুরুতর অভিযোগে বিনা কারণে রাতদিন সাথীকে ভুগতে হয়েছে মানসিক যন্ত্রণায়, শেষ অবধি মদ্যপ বর তাকে ঘরে তালা দিয়ে যেতে শুরু করে। আজ ৭ মাস হলো শরীরে কালসিটে দাগ নিয়ে সাথী ঢাকায় ভেগে চলে এসেছে। একলা সাথীর জীবন এখন আজিমপুরের মহিলা হোস্টেলে কাঁটে। সে কম বেতনে অফিস সহকারীর কাজ করে। হোস্টেলে এসে রাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই প্রতিদিনের জীবনে এই প্রথম সে নিজের মনের কথা শুনছে।

আজকের অন্ধকারের মধ্যে রুদ্রকে দেখা যাচ্ছে না। তবে সে খুব দ্রুত হাঁটছে। মাঝে মধ্যে শার্টের হাতায় ঘাম মুছছে। সব সময়ের মতো আজও তার সাথীর চুপচাপ থাকাটাতে বিরক্ত লাগছে। কৈ যাবে, কখন যাবে, তার বরের কী হয়েছে? কোনো বিষয়েই উত্তর সাথী দিচ্ছে না। সে চুপচাপ হাঁটছে। বড় রাস্তায় পৌঁছতে সাথী ঘুরে রুদ্রকে দেখে। হেসে বলে, আজিমপুরে যাবো আমি। রোবটের মতো রিকশা ঠিক করে হুড উঠিয়ে দিতেই তাতে চড়ে বসে সাথী। রিকশা যখন ছেড়ে যায় তখন বলে, কথা হবে!

বেশ কিছুদিন কেটে যায়। রুদ্রের মনে হয় সেদিন বলে আসলে কোনো দিন ছিল না। হয়তো তার স্বপ্নে বা কল্পনায় সাথী আসলে এসেছিল। সোবহান মামার দোকান থেকে চা খেয়ে এখন প্রায়দিন অফিস শেষে রুদ্র আজিমপুর এলাকায় চলে যায়। রিকশার পাশ দিয়ে, বড় বড় গাড়ির পাশ দিয়ে, কিংবা এলাকার কোনো অচেনা দোকানে বসে বসে হয়তো চা খায়। কাউকে দেখে না কিন্তু সে খুব কান খাড়া করে রাখে। বহু বছর আগে শোনা একটা স্বরের জন্য অপেক্ষা করে। খুব করে চায় কোথাও থেকে কোনো এক শান্ত স্বর বলে উঠুক…রুদ্র!

Advertisement
Share.

Leave A Reply