অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা বা ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য দেশে কোনো নিয়মকানুন ছিল না। ফলে ই-ভ্যালি, আলেশা মার্টসহ সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান যে যার মতো লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহক টানছিল। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের পাশে দাঁড়াতে এবং এসব কোম্পানির লাগাম টেনে ধরতে এই ব্যবসা খাতে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
কিছু শর্তের উল্লেখ করে দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা জারি করেছে সরকার। রবিবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেল।
যেখানে বলা হয়েছে, অনলাইনে পণ্য কেনার জন্য গ্রাহকের মুল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। এরপর তা ক্রেতাকে খুদে বার্তা (এসএমএস) দিয়ে জানিয়ে দেবে। ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ দেওয়ার ৫ দিনের মধ্যে, আর ভিন্ন শহরে থাকলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এ সময় আরও কম রাখতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নির্দেশিকাটির ফলে ই-কমার্স ব্যবসা খাতে শৃঙ্খলা আসবে, গ্রাহক হয়রানিও কমবে। মোটকথা পুরো খাতটি সুস্থ পরিবেশের ধারায় ফিরে আসবে বলে আমরা আশা করছি।’
তিনি আরও বলেন, যারা টাকা দিয়ে এখনও পণ্য পাননি, তাঁরা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ আদালতে আইনানুগ প্রতিকারের জন্য অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং বা অন্যান্য যে মাধ্যমেই পণ্যের অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করবেন ক্রেতা, বিক্রেতা কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে, মূল্য পরিশোধের ১০ দিনের মধ্যে ক্রেতার পুরো টাকা ফেরত দিতে হবে। যে মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়েছে, সে মাধ্যমেই ফেরত দিতে হবে।
তবে যেসব পণ্যের ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি রয়েছে, সরবরাহের সময় সেগুলোর কার্ড ক্রেতাকে দিতে হবে। সেই কার্ডে উল্লেখ থাকতে হবে কত দিন এবং কোথা থেকে এই সেবা পাওয়া যাবে। ক্রেতা যাতে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য পণ্যের মূল্য ও সব ধরনের করের কথা ওয়েবসাইটে উল্লেখ করতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, মার্কেটপ্লেসে বিক্রয়যোগ্য পণ্য বা সেবার যথাযথ বিবরণ, মূল্য, পণ্য পৌঁছানোসহ অন্যান্য খরচের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণের কথাও জানাতে হবে। কোনো নকল বা ভেজাল পণ্য প্রদর্শন করা যাবে না। বহুস্তর বিপণন পদ্ধতিতে (এমএলএম) পদ্ধতিতে কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না। চিকিৎসা বা ওষুধসামগ্রী কেনাবেচার ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে। কোনো ধরনের নেশাজাতীয় পণ্য বিক্রি করা যাবে না এবং জুয়ার আয়োজনও করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো ধরনের অর্থ ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না। ক্রেতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো পণ্য কেনার জন্য বাধ্য করা যাবে না। ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোনো মাধ্যম, যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, সে ধরনের কিছু করা যাবে না।
টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো চার্জ (মাশুল) লাগলে তা মার্কেটপ্লেস বা বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। মূল্য ফেরতের বিষয়টি ক্রেতাকে ফোন, ই-মেইল বা অন্য কোনো মাধ্যমে জানাতে হবে। নির্ধারিত সময়ে অর্থ ফেরত না পেলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করতে পারবেন ক্রেতা।
পণ্য বা সেবা কেনাবেচা, ফেরত ও পরিবর্তনের শর্ত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বা মার্কেটপ্লেসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পণ্য বা সেবা বিক্রি বা প্রসারের জন্য কোনো ধরনের লটারি বা লটারিজাতীয় কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারবে কোনো প্রতিষ্ঠান। কোন পণ্যের স্টক কত, তা-ও জানাতে হবে গ্রাহকদের।
পণ্য স্টক করার জন্য নিজস্ব গুদামঘর থাকতে হবে। অন্য বিক্রেতার পণ্য নিজেদের ই-কমার্স সাইটে বিক্রি করলে কী পরিমাণ পণ্য বিক্রির জন্য আছে, তার ওপর নির্ভর করেই ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ নিতে হবে। কোনো তৃতীয় পক্ষের পণ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করা হলে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকতে হবে।
সব ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যায়ক্রমে ইউনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ইউবিআইডি) বাধ্যতামূলক করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেল দেবে এই ইউবিআইডি। এই সেলের তালিকায় এক হাজারটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিক্রেতার ওয়েবসাইটে কোনো বিশেষ সফটওয়্যার থাকলে তা ক্রেতাকে আগেই জানাতে হবে। অভিযোগ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপ বা প্ল্যাটফর্মে ফোন নম্বর, ই-মেইল বা অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। অভিযোগ রেকর্ডের ব্যবস্থাও থাকতে হবে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। পণ্যের বা সেবার বিষয়ে মতামত বা রেটিং জানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে ওয়েবসাইটে। এসব মতামত মুছে ফেলা যাবে না। আর নির্দেশিকা পালন না করলে অমান্যকারী প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, কোম্পানি নিবন্ধন, ভ্যাট নিবন্ধন বাতিল করে দেবে সরকার।