রিমি খোন্দকার, ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায় জন্ম। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা ফেনীতে,ফেনী জিয়া মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় গমন। এরপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন বিবিএস বাংলা’কে ।
উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জ কেন ?
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশুনা শেষ করে গতানুগতিক ধারার চাকরিতে না গিয়ে কেন উদ্যোক্তা হলাম? অনেকেই এই প্রশ্ন করেন। আসলে আমি চেয়েছি, স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করতে সবসময়। ধরাবাঁধা, যেটাতে নিজে কিছু করার সুযোগ নেই এমন কিছু করতে চাইনি। এজন্যই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।
উদ্যোক্তা জীবনে শুরুর গল্পটা শুনতে চাই
অনেক দিন থেকেই পড়াশুনা করছিলাম ই-কমার্স নিয়ে। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশীয় বিভিন্ন শাড়ি নিয়ে কাজ করবো। কেননা আমি নিজেই শাড়ি প্রেমী। আর মেয়েদের শাড়ির প্রতি বিশেষ টান আছে।
তবে এরই মধ্যে বাঁধার কারণ হয়ে উঠলো করোনা। ফলে পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। অন্যদিকে নিজের, নিজের ফ্যামিলির আশেপাশের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাও শোচনীয়। কাউকে হেল্পও করতে পারছিলাম না। তবে যেহেতু অনেক দিন ধরে ই-কমার্স নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম, তাই কিছু এলাকার তাঁতির সাথে আগেই যোগাযোগ হয়েছিল। মাত্র ২০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম জীবন যুদ্ধে। ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ২০ হাজার টাকার পুরোটা দিয়েই শাড়ি কিনে ফেলি। আর এভাবেই ২০২০ সালের ১ মে থেকে ‘গোলাপজানের’ যাত্রা শুরু করি।
গোলাপজান নামটা কেন?
অনেকেই জিজ্ঞেস করে এই নামটা কেন দিলাম! আসলে আমার মাথায় শুধু পেইজ খুলবো আর সেল করবো এমন ব্যাপার ছিল না। আমি চেয়েছি, পুরোনো ধাঁচের একটা ইউনিক নাম,অবশ্যই বাংলা হতে হবে। বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের দাদি নানিদের নামগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাই গোলাপজান নামটা বেছে নিয়েছি, আমাদের দাদি নানিদের নামকে স্মরণ করার জন্য। আর তারা যেহেতু সবসময় শাড়ি পরতো, আর পেইজে যেহেতু মূল ফোকাস শাড়ি, তাই এই নামটাই বেছে নিয়েছি।
কি কি পণ্য নিয়ে কাজ করছেন?
আমি কাজ করি মূলত দেশীয় শাড়ি,লুঙ্গী আর থ্রি পিস নিয়ে। সম্প্রতি নতুন যুক্ত করেছি বিলুপ্তির পথে থাকা মাটির খোলা নিয়ে। আমি কারিগর দিয়ে প্রস্তুত করাই,অনেক সময় ডিজাইন কাস্টমাইজড করে দিই। পেইজের যাবতীয় কাজ,অর্ডার নেয়া,ডেলিভারি দেয়া সব কাজ আমিই করি।
১ মে অফিসিয়ালি আমার পেইজ গোলাপজানের যাত্রা শুরু করি। শুরুতে ভেবেছিলাম গোলাপজানে শুধু শাড়ি রাখব। তবে এরই মধ্যে খবর পেলাম পাবনার এক তাঁতীর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। যখন করোনার জন্য দেশজুড়ে চলছে লকডাউন, তখন তার ঘরে খাবার নেই। মূলত সে লুঙ্গী বিক্রি করে। তাই, ভাবলাম তার থেকে কিছু লুঙ্গী কিনে নিই। তাহলে তার উপকার হবে। আশ্চর্যের বিষয়, লুঙ্গীগুলো আনার একদিনের মাথায় সব সেল হয়ে গেছে। এরপর থেকে ঐ তাঁতীর কাছ থেকে আমি নিয়মিত লুঙ্গী নিচ্ছি। আর এখন ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়াতে আমরা শাড়ি,থ্রি-পিস,লুংগি,বেডশীড সেল করে থাকি।
আপনার পেইজ বাকিদের চেয়ে ভিন্ন কেন?
আমরা বই প্রেমী, বই পড়তে ভাল লাগে তাই ভাল লাগা থেকে থেকে আমরা সবাইকে বই পড়ার জন্য একটা উদ্যেগ গ্রহন করি। শাড়ির সাথে বই উপহার দিয়ে থাকি এবং আমাদের প্রত্যেকটা পন্যের ছবি তোলার সময় বই রাখি সাথে।তাই আমরা একটু ইউনিক বলতে পারি। শাড়ি,লুঙ্গী কিনে সবাই বই উপহার পায়,তাছাড়া এই সময়কার তরুণ জনপ্রিয় লেখদের সাথে আমরা চুক্তি করি গোলাপজান থেকে নিদিষ্ট পরিমাণের কেনাকাটা করলে বই উপহার দেবো।
জানি না, বাংলাদেশে আর কেউ শুরু করছে কি না। তারপরও বলি, বাংলাদেশে এই প্রথম গোলাপজান নতুন এক ট্রেন্ড শুরু শুরু করলো।গোলাপজান থেকে ৩০০০ টাকার উপরে কেনাকাটা করলে একটি আধুনিক বাংলা বই উপহার পাবেন এবং তার সাথে সাথে এই সময়ের জনপ্রিয় লেখকদের বই উপহার হিসেবে আমরা দিয়ে থাকি। বই আমরা ফ্রি দেই না উপহার দিই। আমার স্বপ্ন, পৃথিবী একদিন বইয়ের হবে।
কি ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?
প্রোডাক্ট সোর্সিং, ডেলিভারি, গ্রাহকদের থেকে নতুন পেইজ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা পাওয়া,লকডাউন নানা সমস্যা ছিল। সাথে মূলধনের সমস্যাতো ছিলই। আমি সবকিছু ধৈর্য দিয়ে অতিক্রম করেছি।প্রচুর অর্ডার থাকলেও আমি মূলধন সংকটের জন্য ডেলিভারি দিতে পারিনি।তখন নিজেকে বুঝিয়েছি আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবো।
অনুপ্রেরণা
উইয়ের রাজীব ভাইয়া এবং নিশা আপু আমার অনুপ্রেরণা। এবং আমার বর মাইনুল আমার জন্য অন্যতম অনুপ্রেরণা সে সব কিছুতে আমাকে সাহায্য করে। উনাদের দেখে উদ্যোক্তা হতে অনেক সাহস পেয়েছি। নয়তো এতোদূর আসতে পারতাম না।
করোনায় বসে অর্থনৈতিক ভাবে,মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা,মানসিক প্রশান্তির জন্য একটা উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরী ছিল। আমি শুধু নিজে ব্যবসা করতে চাইনি,চেয়েছি ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে আমার আশেপাশের সবার উপকার করতে।এখানে মানবিকতার ব্যাপারও জড়িত ছিল।
ভবিষ্যৎ ভাবনা
আমার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া, আমি চাই গোলাপজান দেশের সবার কাছে পরিচিত হোক,সবাই গোলাপজানকে চিনুক।গোলাপজান বিপন্ন মানুষের সহায়তায় সবসময় পাশে দাঁড়াবে,অসহায়কে সাহায্য করবে। বিজনেসের থেকে মানবিকতা বড় হোক।