fbpx

‘বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট’ এখন সময়ের দাবি

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

আবু হানিফ মোহাম্মদ ফরহাদ ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত টার্নিং পয়েন্ট ফাউন্ডেশনে। তিনি রসায়নশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে মন দিয়েছেন মানুষ আর সম্পর্কের রসায়নে। প্রতিবন্ধিতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, মানবাধিকার আর উন্নয়নে। ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ স্বীকৃতি আন্দোলনের একজন কর্মী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিবিএস বাংলা’য় লিখেছেন অনেকের অলক্ষ্যে থাকা একটি বিষয় নিয়ে। 

ভাষার জন্য রক্তদানের গৌরবের ইতিহাস আর কারো নেই। আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস তাই সংখ্যালঘু ভাষা গোষ্ঠীর ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির প্রতীক। সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার বিকাশে ছয়টি ইন্সটিটিউট স্থাপন করে সেই স্বীকৃতি প্রদান করেছে। প্রেক্ষাপটের এই বাঁকেও আমাদের চরিত্রের রহস্যময় অংশটি ধরা পড়ে। বাংলা ভাষাভাষীদের নানান রকম অন্যায় আধিপত্য ওইসকল সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের বাংলা ইশারা ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের (বাংলাভাষী অপ্রতিবন্ধী মানুষ) ভূমিকা ১৯৫২ সালের উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠীর মতো। বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ে অপ্রতিবন্ধী মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালিপনা, অপ তৎপরতা হরহামেশা দেখা যায়। অপ্রতিবন্ধী মানুষ ভাবতেই শেখেনি বা চায় না যে বাংলা ইশারা ভাষা শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের ভাষাগত অধিকার কোনো এনজিও বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্প নয়। বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ে সিদ্বান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের। সরকারি কর্মকর্তা, এনজিওকর্মী বা কোন দোভাষীর নয়।

আশার কথা বাংলাদেশের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ এ সকল অপতৎপরতাকে আমলেই আনে না। সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার স্বীকৃতির ধারাবহিকতা বাংলা ইশারা ভাষার বিষয়টি আরও সামনে নিয়ে এসেছে। এখন সময় আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব আমরা অক্ষুন্ন রাখব, নাকি রাখব না? রাষ্ট্রের স্বীদ্ধান্ত রাষ্ট্র নেবে, শ্রবণ প্রতিবন্ধী জনগণ তার নিজের ভাষার অধিকার ও মর্যাদায় নিজের ভূমিকা নিজে রাখবে। বাংলা ইশারা ভাষার বিকাশে চাই বাংলা ইশারা ভাষা ইন্সটিটিউট- বাংলাদেশের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের এই সময়ের দাবী।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধিতা সন্নাক্তকরণ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত শনাক্তকৃত শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ৭২,২৫৬ জন এবং বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ১,৫২,৬৫৪ জন। প্রক্রিয়ায় ভুল শনাক্তকরণ, এবং সকলের কাছে না পৌছানো এই চলমান কার্যক্রমের ডাটায় উল্টোটাই ধরা পড়ে। মূলত শ্রবণ প্রতিবন্ধিতার কারণে কথা শিখতে না পারা বেশিরভাগ মানুষকে বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। আদতে তারা সবাই শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালে বিশ্বব্যাপি প্রতিবন্ধিতার বিষয়ে যে প্রতিবেদন যাকে এখন পর্যন্ত কম্প্রিহেনসিভ মানা হয় তার মতে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লাখ শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের বাস। এত বড় একটা জনগোষ্ঠীর একটা ভাষা আছে আর তার নাম বাংলা ইশারা ভাষা। এখন সকলেই কী প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষায় ভাব প্রকাশ করেন? এর জবাবে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, বাংলাদেশের সকলেই কী প্রমিত বাংলায় কথা বলেন?

প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষা আর সকল ইশারা ভাষার মতই গৃহভিত্তিক ইশারা ভাষা থেকেই উদ্ভুত, গৃহভিত্তিক ইশারা ভাষা থেকে প্রাগ্রসর একটি ভাষা। ভাষা বিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এথনোলগের মতে পুরো বিশ্বে ১৩৮ – ৩০০ ভিন্ন ধরনের ইশারা ভাষার প্রচলন রয়েছে। এথনোলগের ওই তালিকায় বাংলা ইশারা ভাষা এখনও অন্তর্ভূক্ত নয়। এ থেকেও বোঝা যায় এরকম আরও কত ধরনের ইশারা ভাষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। যার কোনটা যথেষ্ট সম্মৃদ্ধ কোনটা বিকশিত পর্যায়ে আছে। ইশারা ভাষার বাংলাদেশের সংকট ও সংকটের ধরণও অপরাপর সংকটের মতই। এখনও দ্বিধায় থাকেন মানুষ বাংলা ইশারা ভাষা কী আদৌ ভাষা নাকি পদ্ধতি, যেমন ব্রেইল। আর কেউ কেউ নিজের মত করে ইশারা ভাষা বানাতে থাকেন। কারণ যখন পদ্ধতি বলে ধরে নিবেন, দরদী মাত্রই স্বাভাবিকভাকেই সেই পদ্ধতির উন্নয়ন করতে চাইবেন। মুশকিল হচ্ছে, একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা আপনি বানাতে পারেন না। ভাষা একটা সংস্কৃতিজাত, ইতিহাসের স্বতঃস্ফুর্ত ধারায় বিকাশলাভ করে থাকে। অপরাপর সব মৌখিক ভাষার মত সকল উপাদান, বৈশিষ্ট্য এই ভাষাটি ধারণ করে। আর ভাষায় জোরজবরদস্তিও চলে না। বাঙালিদের চেয়ে আরও ভাল করে জানে কে আছে আর!

কলকাতা মূক বধির বিদ্যালয়ে (প্রতিষ্ঠিত ১৯৩৫ সাল) পূর্ববঙ্গ থেকে মঞ্জুর আহমেদ পড়তে যান। ঐ বিদ্যালয়ে কর্মজীবন ও কলকতা মূক বধির সংঘ’র পর্ব শেষ করে ফিরে আসেন পূর্ব বঙ্গে। ‘বধিরদের বাঘ’ খ্যাত শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মঞ্জুর আহমেদ নিজেই হয়ে ওঠেন একটি প্রতিষ্ঠান। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষক এই শিক্ষক সারা জীবন ব্যয় করেন তাদের উন্নয়নে ও বাংলা ইশারা ভাষার বিকাশে।

বাংলা ইশারা ভাষার বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিকরন করার কাজটি শুরু হয় বগুড়া মূক বধির বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৬৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান মূক বধির সংঘ’ নামে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। সংস্থাটির নাম পরবর্তীতে হয় বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা। ধরেই নেয়া হয় প্রতিবন্ধী মানুষদের উন্নয়নে মহান সব এনজিও কোনো মহান অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে থাকেন। উল্টো বিষয়টা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এই সংগঠনগুলোকে বলা হয় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন’ বা ডিপিও (ডিসঅ্যাবল্ড পিপলস অর্গানাইজেশন)। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য যত পরিবর্তন বিশ্বব্যাপি হয়েছে তার সিংহভাগ এই ধরনের ‘ডিপিও মুভমেন্ট’ এর ফলে। ‘ডিপিও’গুলো আসলে প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরা প্রতিষ্ঠা করে নিজেরাই পরিচালনা করে থাকেন।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রথম সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ইশারা ভাষার বিকাশে কাজ শুরু করে। সংস্থাটির আওতায় জেলায় জেলা ‘বধির সংঘ’ নামে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করে। নিজেদের সম্প্রদায় চেতনা, নিজেদের ঐক্য আর যেকোনো জনগোষ্ঠী থেকে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের অনেক মজবুত। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এই ভাষার বিকাশ।

‘বাংলা ইশারা ভাষা পরিষদ’ গঠন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৪ সালে একটি বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান প্রকাশ করে। যা এখন পর্যন্ত বাংলা ইশারা ভাষার একমাত্র নথি। ইতোমধ্যে এনজিও উন্নয়ন দৌরাত্মে বাংলা ইশারা ভাষা বিষয় নিয়েও টানা হেঁচড়া শুরু হয়। বিদেশি দাতাসংস্থা নির্ভর ইশারা ভাষার কৃত্রিম উন্নয়নকে বাংলা ইশারা ভাষার উন্নয়ন বলে চালানোরও একটা পায়তারা দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশের শ্রবণ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এ সকল অপতৎপরতাকে আমলেই আনে না। তাদের ভাষার বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় চলমান, কখনও সবেগে কখনও ধীরগতিতে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে একুশে বইমেলা উদ্ধোধনে বলেন, ‘বাংলা ইশারা ভাষা এদেশের অন্যতম ভাষা।’ তিনি শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে ইশারা ভাষায় সংবাদ প্রচারের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ‘এসডিএসএল’ এর কারিগরি সহযোগিতায় বিটিভি ও দেশ টিভিতে বাংলা ইশারা ভাষায় সংবাদ প্রচার করা হয়। যদিও আজ পর্যন্ত বিটিভির প্রধান সংবাদ রাত ৮টার সংবাদে বা সকল টিভি চ্যানেলে বাংলা ইশারা ভাষায় সংবাদ প্রচার করা হয় না। এমনকি বিটিভির ইশারা ভাষায় সংবাদ পাঠক নিয়োগে নানান অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির উপস্থিতেতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বাংলা ইশারা ভাষায় দোভাষীসেবার প্রচলন হয়।

সাম্প্রতিককালে বাংলা ইশারা ভাষার প্রচারে ধূমকেতুর মতো যে মানুষটি এগিয়ে এসে বড় ঝাকুনি দিলেন তিনি রফিক জামান। সোসাইটি অব দি ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স (এসডিএসএল) প্রতিষ্ঠা করে বাংলা ইশারা ভাষা প্রচার ও প্রসারে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিলেন। দোভাষীসেবা জনপ্রিয়করণ, টিভিতে বাংলা ইশারা ভাষায় দোভাষীসেবা, আদালতে দোভাষীসেবা সহজকরনের কাজ। এবং শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তাদের প্রবেশগম্যতার অন্যতম বিষয় বাংলা ইশারা ভাষার জন্য একটি দিবস উদযাপনের স্বীকৃতি আদায়ে তিনি কাজ শুরু করেন। বাংলা ইশারা ভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষ ২০১১ সালে ১৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন। এছাড়া বিভিন্ন ধাপে এই দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের কাজটি নেতৃত্ব দেন রফিক জামান। যার ফলে ২০১২ সালে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা ইশারা ভাষা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালে বিমান দুর্ঘনায় সপরিবারে রফিক জামান নিহত হন। এক ফুৎকারে এসডিএসএল কেন্দ্রীক বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়কসকল কিছু নিভে যায়। কিন্তু ভাষা তো কোনো সংগঠনের নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমের বিষয় নয়। শুরু থেকেই এই ভাষাটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘাটে ধাক্কা খেয়ে এসেছে। আর প্রতিবন্ধিতার সুযোগে এনজিও ব্যবসায়ী, পন্ডিতব্যক্তি, সরকারী কর্মচারী সকলেই ভাষাটির অমর্যাদা, প্রতারণা করার সুযোগ নিয়েছেন। কেউ কেউ আন্তরিক হলেও আখেরে তার অবুঝ আন্তরিকতা ভাষাটিকে আরও সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ বাংলা ইশারা ভাষার স্বীকৃতি, মর্যাদা ও সুরক্ষায় জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ ছাড়াও আমাদের আছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’, এর বিধিমালা (২০১৫), এবং কর্মপরিকল্পনা (২০১৯)। যেখানে সুস্পষ্টভাবে বাংলা ইশারা ভাষার মর্যাদা ও বিকাশে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া আছে।

বাংলা ইশারা ভাষার বিকাশে ‘বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট’ এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভায় এই ইনস্টিটিউটের মৌখিক স্বীকৃতি মিলেছে ২০১৩ সাল থেকেই। এখন অপেক্ষা সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের।

Advertisement
Share.

Leave A Reply