fbpx

বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

সোনম সাহা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার্থে অবস্থান করছেন। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পড়তে, জানতে ও লিখতে ভালোবাসেন। বিবিএস বাংলা’র মতামত বিভাগে সোনম সাহা লিখেছেন বাঙালির বর্ষবরণের ঐতিহ্য নিয়ে।

পৃথিবীর একটা বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ যখন থেকে গ্রহ- নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য বিচার করে তাদের জীবন ও জীবিকার নানান সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে তখনও তারা নিজেদের ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতো। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিলো মূলত গোত্র নির্ভর। তখনও কোনো ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক উৎপত্তি কিংবা বিকাশ হয়নি। আমরা কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান- এইসব আলাপ অনেক অনেক পরের।

কোনো বর্ষপঞ্জিই কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের জন্য হয় না। সেটা সবার জন্য হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিও সবার জন্যই হয়েছিলো। আগেকার মানুষ পঞ্জিকা মিলিয়ে মূলত কৃষিভিত্তিক সিদ্ধান্তগুলো নিতো। অমাবস্যা পূর্ণিমা মিলিয়ে জোয়ার-ভাটা আর খরা-বন্যা, শীত-বর্ষার হিসেব তাদের রাখতে হতো। বাংলা সালকে ফসলি সালও তাই বলা হয়। ফসল তো সব ধর্মের মানুষকেই ফলাতে হতো। তাই সহজেই বলা যাচ্ছে, এই বর্ষপঞ্জি কেবল নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে বিবেচনায় নিয়ে হয়নি। এই অঞ্চলের ভূগোল ও প্রকৃতি বিবেচনায় সকলের জন্য হয়েছিলো।

তাহলে কেবলমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীরাই কেন বাংলা পঞ্জিকা মেনে তাদের পূজা পার্বণ জন্ম মৃত্যু বিবাহ আচার করেন? কারণ, সনাতন বা হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি তথা বাঙালি সংস্কৃতির উৎপত্তি আর এই বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি একই ভূমিতে, সমসাময়িক যাত্রায়। একইভাবে বৌদ্ধ পার্বনগুলোও কিন্তু বাংলাপঞ্জি মতে পূর্ণিমা মিলিয়ে হয়। ঠিক একই কারণে আরবি হিজরি সাল হিসেবে করে মুসলিম পার্বণ এর দিন নির্ধারণ করা হয়। কারণ, ইসলাম ধর্ম ও আরবি বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি একই জায়গায়। সবক্ষেত্রেই ক্যালেন্ডার এর সাথে উৎসবকে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে। উৎসব এর জন্য বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি হয়নি। হিন্দু পার্বনের সময় অনেক শাস্ত্রবিচার করে নির্ধারিত হয়। তারপর হিসেব করে মিলিয়ে নেয়া হয় যে শাস্ত্রমতে নির্ধারিত দিনটি বাংলা কোন মাসের কত তারিখ। একই ভাবে দেখা যায়, উত্তরাখন্ডের হিন্দুদের পার্বণে বাংলা বর্ষপঞ্জি বিবেচিত হয় না, কারণ বাংলা বর্ষপঞ্জি কেবলমাত্র বাঙালিরা অনুসরণ করে। বাংলা বর্ষপঞ্জি যদি একান্ত হিন্দুয়ানিই হতো তবে তা সব অঞ্চলের হিন্দুরাই অনুসরণ করতো৷

বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার এই ধারা এখনো ধর্মনিরপেক্ষই আছে। আপনি যেকোনো একটি পঞ্জিকা হাতে নিলেই দেখবেন তাতে শুধু কবে কোন পূজা তার উল্লেখ আছে তা নয়; চাঁদের প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ হিসাব করেকবে শবেবরাত, কবে রমজান শুরু, কবে ঈদ,কবে মহররম; এসবেরও নির্ভুল উল্লেখ থাকে। বাংলা ও ইংরেজি তারিখের সাথে হিজরি সাল ও মাসের তারিখ দেয়া থাকে।

এখন আমাদের দেশের মুসলমানদের ধর্মাচরণের সংশ্লিষ্টতা বাংলা ক্যালেন্ডার এর সাথে হবার সুযোগ নেই, কারণ রোজা বা ঈদ এর মতো বিষয়গুলো হিজরি সাল নির্ভর। কিন্তু বাঙালি মুসলমান যে বাংলা ক্যালেন্ডার জীবনে প্রয়োগ করতো, তার অজস্র প্রমাণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে। খেয়াল করলে দেখা যায়, গ্রামের কৃষক এখনো কবে ধান তুলবে আর কবে পাট জাগ দেবে কবে রবি শস্য বুনবে তা পৌষ, আষাঢ় বা অঘ্রাণ হিসেব করেই বলে। জুন মাসে পাট উঠবে এই কথা কোন কৃষক এর মুখে শুনবেন না। এটা যে ফসল এর সাথে সম্পর্কিত বর্ষগণনা, এই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

আগের কবি সাহিত্যিকদের দিকে তাকালে দেখা যায়, হিন্দু বা মুসলিম যেই হোক, তাদের বাংলা জন্মসাল তারিখ পাওয়া যায়। ইংরেজি তারিখ ক্যালেন্ডার থেকে পরে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে। আপনি পুরনো আমলের কাউকে জিজ্ঞেস করুন, তার জন্ম কবে, সন্তানের জন্ম কবে, স্বামীর মৃত্যু কবে; আপনি উত্তর পাবেন শ্রাবণ মাসে বা মাঘ মাসে বা চৈত্র মাসে। ইংরেজি তারিখ তারা বলতেই পারবেন না।

যেকোনো পুরনো জমির দলিল, বিয়ের কার্ড হাতে নিন, বা খুব পুরনো ডায়েরি, দেখবেন হিন্দু মুসলিম সবাই বাংলা সাল তারিখ উল্লেখ করেছেন। তারপর হিজরি সাল লিখেছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী কেউ হলেও তাই ঘটে। বাংলার দুর্ভিক্ষগুলোর নাম মনে করেন, ইংরেজ আমলে দুইটা মন্বন্তর হয়েছিলো, প্রথমটা আমরা বাংলা সাল দিয়েই আজো চিহ্নিত করি, দ্বিতীয়টা খ্রিস্টাব্দ দিয়ে। কারণটা সহজেই অনুমেয়।

বাংলা বর্ষপঞ্জি সকল বাঙালির৷ কোনকালেই এটা একা হিন্দুদের ছিলো না৷ কিন্তু যেহেতু বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতি ও বাঙালি সংস্কৃতি প্রায় অভিন্ন তাই যাবতীয় যা কিছু বাঙালির নিজস্ব তাতেই হিন্দুয়ানীর ছাপ মেরে দেয়ার দুর্ভাগ্যজনক রাজনীতিটা করা হয়৷

এবার, দ্বিতীয় আলাপে যাই। বাংলা বর্ষপঞ্জির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সহজে নির্ণেয় না। আমরা খুব সহজেই ২০৩০ সালের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ কী বার তা বলে ফেলতে পারি কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞান না জেনেই। কিন্তু ১৪৩০ সালের শ্রাবণ মাস কতদিনের হবে সেটাই জানতে পারিনা। এটা জানার জন্য আমাদেরকে চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে জানে এমন কারো শরনাপন্ন হতে হচ্ছে। কয়েকদফা সংস্কার এর পর এটা একটা জায়গায় এসেছে। তারপরেও প্রতি বছর এর ক্যালেন্ডার এর কোনো ইউনিফর্মিটি নেই। ইউনিফর্ম আর কমনলি প্রেডিক্টেবল কিছু না হলে ইউনিভার্সাল হওয়ার সুযোগ থাকে না। নানান পর্যায়ে সংস্কার হয়ে আসা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মানে খ্রিস্টিয় বর্ষই সবচেয়ে বেশি ইউনিফর্মড। তাই এটাই সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য।

বাংলা নববর্ষ, চাইনিজ নববর্ষ, ইরানিয় নববর্ষ, আরবি নববর্ষ, ইনকা নববর্ষ- এগুলো সবই এখন নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ। পৃথিবীর সব জাতিই তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে গর্ব করে, বহন করে, লালন করে। কিন্তু আমরা আমাদের নৃতত্ত্ব আর সংস্কৃতিতে ধর্মের দাগ লাগিয়ে নিজেদের অতীত ও ব্যুতপত্তি অস্বীকার করতে চাই,এটা আমাদের ব্যর্থতা ও দু:র্ভাগ্য।

 

Advertisement
Share.

Leave A Reply