প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তেলার প্রত্যাশায় যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী চাই। আমরা যুদ্ধ চাই না, ধ্বংসযজ্ঞ, অস্ত্র ব্যবসা, কোনো শিশুকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা এবং কাউকে গুলি করে হত্যা করা হোক, আমরা তা চাই না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) সকালে জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২২’-এর উদ্বোধনী এবং ‘শেখ রাসেল পদক-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে এই আহ্বান জানান।
তিনি গণভবন থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আস্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এই আয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন)। কত শিশু আজকে এতিম হয়ে যাচ্ছে, কত শিশু কষ্ট পাচ্ছে। আমরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, সেখানেও তো শিশুরা পরভূমে রিফিউজি হিসেবে মানুষ হচ্ছে।’
তাঁর নিজেরও রিফিউজি থাকার এবং বন্দি অবস্থায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাই, আমরা যুদ্ধ চাই না, কোন সংঘাত চাই না। আর রাসেলের মত আর কোন শিশুকে যেন জীবন দিতে না হয়। আমরা চাই, প্রত্যেকের ভবিষ্যত সুন্দর হোক, উন্নত হোক।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭৫-এর পর দেশে ১৯টি ক্যু হয়েছে, আমাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হাজারো অফিসার-সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে। স্বজনরা তাদের লাশও পায়নি, গুম করে ফেলা হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, কারাভোগ করেছে, মৃত্যুবরণ করেছে। কাজেই, আর আমরা এই স্বজন হারানোর বেদনা, কান্না শুনতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, উন্নত হোক। আমরা ৫ হাজার কম্পিউটার ল্যাব এবং ৩০০টি স্কুল অফ ফিউচার উদ্বোধন করলাম। এর আগে আরো ৮ হাজারটি উদ্বোধন করেছিলাম, এতে প্রায় ১৩ হাজারটি ডিজিটাল ল্যাব করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে আমাদের ছেলেমেয়েদের আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা-এটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শিশুদের যে মেধা তা বিকাশের যেন সুযোগ হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় তারা উন্নত হবে, প্রগতির সাথে এগিয়ে যাবে, প্রযুক্তি শিক্ষা নেবে, বিজ্ঞান শিক্ষা নেবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আজকের শিশুরাই হবে আগামী দিনের কর্ণধার। আজকের শিশুরাই এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। কোন মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয়, কোন শিশু যেন নির্যাতিত না হয়। প্রত্যেকেই যেন সুন্দর জীবন পায় সেটাই আমরা চাই। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের কাজ আমরা করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, লেখাপড়া, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষা এবং বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা, প্রতিনিয়ত যেসব প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে সেসব পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা- সেভাবেই বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের সকল শিশুর মেধা বিকাশের সুযোগ হোক।
‘আজকে রাসেল নেই, আমরা তো সবই হারিয়েছি, কিন্তু বাংলাদেশটা যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়,’ যোগ করেন তিনি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সম্পাদিত ‘দুরন্ত প্রাণবন্ত শেখ রাসেল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের ট্রেলারও প্রদর্শিত হয়।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম, বাংলাদেশ জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মহাসচিব কে এম শহীদুল্লাহ ও শিশু বক্তা আফসা জাফর সৃজিতা।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিজয়ীদের মধ্যে ‘শেখ রাসেল পদক-২০২২’ বিতরণ করেন।
শেখ রাসেল দিবস-২০২২ উপলক্ষে দেশব্যাপী কুইজ, ক্রীড়া, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে শেখ রাসেলের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি এবং আইসিটি বিভাগ কর্তৃক নির্মিত শেখ রাসেল দিবস-২০২২ উপলক্ষে একটি থিম সং পরিবেশিত হয়। পরে শিশুদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় আরো বলেন, ‘ফিরে এসে আমি যখন মামলা করতে যাই বা তার আগেও চেষ্টা করেছি কিন্তু সেই মামলা করা যায়নি কারণ আইনে বাধা। আমার প্রশ্ন-আজকে তো অনেক মানবাধিকারের কথা বলা হয়, কারো অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিচার চাওয়া হয়। তাহলে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, তারা কি অপরাধ করেছিলাম?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে, ভাই হারিয়েছে, বোন হারিয়েছে তাদের অপরাধটা কোথায় ছিল?’
তিনি বলেন, ‘আজকে আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের কথা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ- কত কিছুইতো হয়, সেখানে আমার একটা প্রশ্ন- তখন কেউতো আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। হ্যাঁ, আমার দল এবং বাংলার জনগণ ছিল। কিন্তু যারা এই ঘাতকদের সাথে ছিল এবং তাদের সহযোগিতা করেছিল, এই চক্রান্তের সাথে ছিল এবং হত্যাকান্ডের পর যারা এই ঘাতকদের পুরস্কৃত করেছে, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। এমনকি যে ঘাতক মরে গেছে তাকেও প্রমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। এই অবিচারগুলোতো আমি এসে (দেশে ফিরে) নিজের চোখে দেখেছি। তাহলে আমরা মানবতার, মানবাধিকারের এত গালভরা কথা শুনি কেন? আমার প্রশ্নের জবাব কি কেউ দিতে পারবে?’
তিনি বলেন, বিচার করতে পেরেছি তখনই, যখন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আমি সরকার গঠন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছি তখনই। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে সেই বিচার করতে হয়েছে। সে বাতিলের পথেও অনেক বাধা ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জানি এবং শুনি ”বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে” ঠিক সেটাই হয়েছিল আমাদের বেলায়।
উচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্সের রায়ের শুনানিতে বিচারকদের কারো কারো ‘বিব্রত বোধ’ করার করার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।’
তিনি বলেন, ‘৯৮ সালের ৮ নভেম্বর যখন জাতির পিতা হত্যা মামলার বিচারের রায় ঘোষণা করা হবে সেদিন বিএনপি হরতাল ডেকেছিল এবং এরপর যখন আমরা সরকারে ছিলাম না তখন বিচার প্রক্রিয়াটাকেই বন্ধ করে রাখা হয়।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘৭৫ এর যারা ক্ষমতায় এসেছে সেনা শাসক জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ বা খালেদা জিয়া- প্রত্যেকেই এই খুনীদেরকে মদদ দিয়েছে, পুরস্কৃত করেছে। এমনকি, ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন সেই খুনী পাশা এবং হুদাকে নিয়ে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ)’ নামে রাজনৈতিক দলও করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবেই তাদের পুণর্বাসিত করা। জেনারেল এরশাদ খুনী ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছে। আর খালেদা জিয়া রশিদ এবং হুদাকে জনগণের ভোট চুরি করে। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত করে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসায়। আর আজকে তারা ভোটের কথা বলে।
তিনি বলেন, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার দুই দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সেনা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই আবার নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। আর এই খুনীদেরকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স করে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের মুখেই আজকে গণতন্ত্রের কথা, ভোটের কথা, মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়।’
তিনি বলেন, সত্যকে মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা এবং দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল, জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচার হবার মাধ্যমে আজকে জাতি তার থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর বারবার আঘাত আসার, হত্যা প্রচেষ্টার পরও এই দিনটি দেখবেন বলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন।
অনুষ্ঠানে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে রাসেলের জন্ম, দুরন্ত শৈশব এবং মৃত্যুকালীন ঘটনার মর্মন্তুদ স্মৃতি রোমন্থন করেন প্রধানমন্ত্রী।