fbpx

রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি: ‘মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছাত্ররা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে’

Pinterest LinkedIn Tumblr +
Advertisement

আমি এসএম আব্দুল হাকিম, জন্ম ১৯৫৩ সালের ৪ এপ্রিল। বাবা শেহাব উদ্দিন কৃষিকাজ করতেন মা নজিরন নেছা গৃহিণী। গ্রাম নলসন্দা, ইউনিয়ন সলপ; উপজেলা উল্লাপাড়া, জেলা- সিরাজগঞ্জ। সাত ভাইবোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। আমার মেঝো ভাই আব্দুল গণি সিরাজগঞ্জ এসডিও কোর্টের নাজির ছিলেন, থাকতেন আমবাগান পরে মোক্তার পাড়ায়। আমি তার বাসায় থেকে লেখাপড়া করতাম ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে। স্কুলে অনেকেই ছাত্রলীগ করতেন, স্কুলের অনেক সাবেক ছাত্র মহকুমা ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন, তারা প্রায়ই আসতেন স্কুলে, আমাদের নিয়ে যেতেন মিছিলে। তবে নিজে থেকে বা কারো সাহচার্যে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হইনি। ১৯৬৮ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করি এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই।

আমার নিকটাত্মীয় রফিকুল ইসলাম বকুল তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের বড় নেতা। আমিও যুক্ত হয়ে পড়ি ছাত্রলীগের সঙ্গে। হয়ে উঠি ছাত্রলীগ কর্মী। নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিতে থাকি। ১৯৭০-এর মাঝামাঝি সময়ে এলাকায় চলে আসি, যোগাযোগ গড়ে ওঠে উল্লাপাড়া ছাত্রলীগের সঙ্গে। সেখানকার ছাত্রলীগ নেতা জয়দেব সাহা (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) এবং গিয়াসউদ্দিন (কালীগঞ্জ, রক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত) আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। খবর পেলেই ছুটে যেতাম উল্লাপাড়ায় জনসভা, কর্মীসভা, মিছিলে। নেতারা এ অঞ্চলের কোনও স্কুলে আসতে চাইলে সব আয়োজন করতাম। এ সময়ে গ্রামীণ রাজনীতি অনুযায়ী গ্রামের মুরুব্বীরা মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন, আর ছাত্ররা ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ স্বায়ত্বশাসনকামী হয়ে উঠছিলো। ছাত্ররা তাদের যুক্তিতে অটল থাকতো, বিভিন্ন উদাহরণ দাঁড় করিয়ে স্বায়ত্বশাসনের, দুই পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা যুক্তি দিয়ে বলতো। ছাত্রদের একটি ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছিল যে, তারা কোনও অন্যায় করতে পারে না, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে। ফলে, মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছাত্ররা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। গ্রামের সাধারণ মানুষ আসলে ‘পাকিস্তানের’ কাছে সুবিচার আশা করছিল।

এ পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ (এমএনএ) পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন মাওলানা আব্দুল রশীদ তর্কবাগীশ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) প্রার্থী হন অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন। মুসলিম লীগের প্রার্থী হন এমএনএ পদে মনি তালুকদার ও এমপিএ পদে মমতাজ মাস্টার (সলঙ্গা)। গ্রামাঞ্চলে আওয়ামী লীগের তেমন কোনও সংগঠন না থাকায় আমরা ছাত্ররাই এলাকার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নেই। ‘৬৯-এ ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল মুসলিম লীগ। খুব সহজেই বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। একই ভাবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সব আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয় দলটি। এতে অন্য কোনও দলের সমর্থন ছাড়াই পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের সামর্থ অর্জন করে।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুরে রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়, ৩ মার্চ পল্টনে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার আহ্বান জানান। তিনি আহ্বান জানান, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলা’র। সেই সঙ্গে তিনি গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার জন্য বলেন। উল্লাপাড়ায় শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। তার দেখাদেখি আমরা নলসন্দা গ্রামের ছেলেরাও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। এই প্রশিক্ষণের মূল সংগঠক হয়ে ওঠেন আমার বড় ভাই এসএম আব্দুল কাদের। প্রশিক্ষণের স্থান করা হয় নলসন্দা পুরনো খেলার মাঠ। লক্ষ্মীকোলা গ্রামের ইপিআর সদস্য জহিরউদ্দিন বাবর তখন এলাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। প্রতিদিন সকালে প্রশিক্ষণ হতো। আমরা প্রশিক্ষণে ব্যবহার করতাম বাঁশের লাঠি। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ২০/২৫ জন তরুণ। আমরা যারা প্রশিক্ষণ নেই তাদের মধ্যে এই মূহুর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে, তারা হলেন- এসএম আব্দুল কাদের, আরজান আলী, আনোয়ার হোসেন ঠাণ্ডু, রওশন আলী, শামসুল আলম, আব্দুল মজিদ, রণজিৎ সূত্রধর, আমানউল্লাহ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুর রাজ্জাক, আমজাদ হোসেন, গোলাম আজম প্রমুখ। আমাদের প্রশিক্ষণ দেখতে একদিন নলসন্দায় আসেন অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, ফোকলোর বিশেষজ্ঞ)। এসময় স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন তিনি। তাঁর বক্তৃতায় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোনও মূল্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করে জনগণের সঙ্গে থাকার পরামর্শ দেন। এ প্রশিক্ষণ পুরোদমে চলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত।

২৫ মার্চ ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে হামলা চালায় পাকসেনারা। নির্মম নির্যাতন নেমে আসে বাঙালিদের ওপর। সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে বাঙালিরা। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের গুলি করে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, গ্রামের পর গুড়িয়ে দেওয়া- পাকসেনারা সব ধরণের নির্যাতনই চালাতে শুরু করে। এতে পাকিস্তানের প্রতি যেটুকু মোহ সাধারণ মানুষের ছিল তা-ও নিঃশেষ হয়ে যায়। এ সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বিভিন্ন শহর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রামে আসতে শুরু করে বাঙালিরা। তাদের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের খবর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুতের মতো। আমাদের গ্রামেও শহুরে আত্মীয়-স্বজন এসে ভরে যায়। তাদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ রাজনীতির সর্বশেষ খবরাখবর পেতে শুরু করে। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হয়ে ওঠে প্রধান আলোচ্য বিষয়। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে বাঙালিরা।

২৫ এপ্রিল বাঘাবাড়ি পার হয়ে পাকিস্তানিরা নগরবাড়ী-বগুড়া সড়ক দখল করে নেয়। ২৭ এপ্রিল মহকুমা শহর সিরাজগঞ্জও দখল করে পাকসেনারা। সিরাজগঞ্জ মহকুমা, উল্লাপাড়া শাহজাদপুর থানায় স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। গঠন হয় রাজাকার বাহিনীও। পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচারে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে সাধারণ মানুষ। গ্রামের মুরুব্বীরাও আমাদের প্রকাশ্যে বের হতে বারন করতে থাকেন। স্বাধীনতার আলোচনা ধীরে ধীরে গোপনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা নিজেরাও অনেকটা আত্মগোপন করে থাকতে শুরু করি। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকি যে, কিভাবে অস্ত্র পাওয়া যাবে, প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে। খোঁজ নিতে শুরু করি আমাদের নেতাদের। খবর পাই, ছাত্রনেতারা অধিকাংশ চলে গেছেন ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাঙালি তরুণদের হাতে দেশ স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। ততদিনে পাকসেনা ও তাদের দোসরেরা দেশের অবস্থা তাদের মতো করে স্বাভাবিক করে নিয়ে এসেছে। বাস-ট্রেন চলতে শুরু করেছে তবে তাতে যাত্রী নেই বললেই চলে।

আমরাও ভারতে যাওয়ার জন্য দল গোছাতে শুরু করি। পরিকল্পনা করি কোন পথ ধরে ভারত সীমান্ত পার হবো। প্রথমে অনেকেই রাজী হয়, তারপর দেখা যায় কাউকে বাড়ি থেকে যেতে দিতে চায় না, কেউ কেউ নিজে থেকেই পিছিয়ে যায়। বেশ কয়েক জনে মিলে পরিকল্পনা করলেও অবশেষে সলপ স্টেশনে হাজির হতে পারি আমরা তিনজন। এ তিনজন হলাম আমি, হাসমত আলী, আব্দুল মোতালেব। আমরা যে একই পথের যাত্রী তা যেন কেউ বুঝতে না পারে এ জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী চোখে চোখে কথা হয় আমাদের, ঈশ্বরদীর ট্রেনে উঠে পড়ি ভিন্ন ভিন্ন কামরায়। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নেমে পড়ি ঈশ্বরদীর আগেই মুলাডুলি স্টেশনে। সেখান থেকে টমটমে উঠে লালপুরের দিকে রওনা হই। আমাদের ভয় ছিল লালপুর থানা এলাকা পার হওয়া নিয়ে, কারণ আমাদের জানা মতে সেখানে ছিল পাকসেনাদের একটি ক্যাম্প। কিন্তু কোনও সমস্যা হয় না। আমরা ভয়ে ভয়ে বিচ্ছিন্নভাবে লালপুর থানা পার হয়ে চলে যাই লালপুরের পদ্মার চরের বাথানবাড়ি গ্রামে, খুঁজে বের করি হাসমতের ক্লাসমেট জহুরুল ইসলামের বাড়ি। ওরা দুজন এক সঙ্গে রাজশাহীর একটি কলেজে পড়াশোনা করতো। সহজেই পেয়েও যাই জহুরুলকে। এরপর সুযোগ বুঝে পার হই সীমান্ত। পৌঁছে যাই ওপারের জলঙ্গী ইয়থ ক্যাম্পে। কিন্তু ওই ক্যাম্পটি তখন পরিত্যাক্ত অবস্থায়। দুচার জন যারা ক্যাম্পে আছে, তারা জানায় যে, এই ক্যাম্প থেকে আর কোনও মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় না। ওখান থেকেই আমরা ঠিকানা পাই কেচুয়াডাঙ্গা ইয়থ ক্যাম্পের। আমরা চলে যাই সেখানে।

কেচুয়াডাঙ্গা ইয়থ ক্যাম্পে মূলত পাবনা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা, তবে সিরাজগঞ্জেরও অনেককেই পাওয়া যায় সেখানে। তাই আমরা ৩ জন সেখানে নাম লেখাই। ক্যাম্পে দেখা হয় আমার ফুপাতো ভাই মতিউর রহমানের সঙ্গে। ওরা পাবনাতেই থাকতো এবং সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী। ক্যাম্পে গিয়েই পাওয়া যায় আমাদের গ্রামের বৈদ্যনাথ দত্তকে। গ্রামে আমরা এক সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ওকে পেয়ে আমরা তিনজন ভীষণ খুশি হই। আর মতিউরকে পেয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হয়, কারণ পাবনা ছাত্রলীগের সবার সঙ্গে আমার চেয়ে ও’ অনেক বেশী পরিচিত। ওই ক্যাম্পের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন পাবনা ছাত্রলীগের নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল। তিনি ওখান থেকে বিএলএফের সদস্য রিক্রুট করতেন। আমরা ওই ক্যাম্পে নাম লেখানোর সপ্তাহ খানেক পরেই বিএলএফের পক্ষ থেকে রিক্রুট করা হয়, তাতে মতিউরের নাম থাকলেও আমাদেরকে বাদ দেওয়া হয়। এতে বকুল ভাইয়ের কাছে গিয়ে বেঁকে বসে মতিউর, সে আমাদের রেখে হায়ার ট্রেনিংয়ে যাবে না। তখন বকুল ভাই আমাকে ডেকে সিরাজগঞ্জের ১০/১২ জনকে খুঁজে বের করতে বলেন। আমি তখন খুঁটে খুঁটে উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুরের ১২ জন পাই, তাদের সঙ্গে নিয়ে বিএলএফের প্রশিক্ষণে চলে যাই।

কেচুয়াডাঙ্গা থেকে আমাদের ট্রেন যোগে নিয়ে যাওয়া হয় পাঙ্গায়। সেখানে বিএলএফের চার নেতা শেখ ফজুলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ আমাদের নিয়ে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করেন। তারা প্রত্যেকেই বার বার আমাদের ‘রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করেন। এরপর আমাদের ট্রেনে বাগডোগরা পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিমানে দেরাদুনের শাহরানপুরে। আবার ট্রাকে তেন্ডুয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণ হয় ৪২ দিন। ভারতীয় প্রশিক্ষকের অধীনে নানা ধরণের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হয় রাজনৈতিক আলোচনা। এসব প্রশিক্ষণে কথা বলতেন হাসানুল হক ইনু, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হকসহ আরো অনেকে।

তারা বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা নিয়ে কথা বলতেন। সেই সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নিয়ে কথা বলতেন। তারা বলতেন, ভারতে প্রশিক্ষিত বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে মূলভিত্তি। এরা দেশের ভেতরে গিয়ে প্রথমেই অস্ত্র লুকিয়ে ফেলবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে জনমত আছে, তাকে সুসংগঠিত করতে হবে। গ্রাম কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি গড়ে তুলতে হবে। এদের মধ্যে থেকে সাহসী রাজনৈতিক কর্মী সংগ্রহ করে গড়ে তুলবে ছোট ছোট মুক্তিযোদ্ধা দল, যারা জনগণের সঙ্গে মিশে থাকবে। এ সব মুক্তিযোদ্ধা দল জনগণের মধ্যে অবস্থান করে প্রাথমিক অবস্থায় বড় শত্রুকে এড়িয়ে দুর্বল শক্তিকে আঘাত করবে। ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণে না যাওয়ার জন্যও বলা হয় বারবার। বলা হয়, এতে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন ভাবে পাকসেনা ও তার দোসরদের আতঙ্কিত করার জন্য ছোটখাট আক্রমণ করবে। এ ভাবে গ্রামের পাকিস্তানি শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। এক সময়ে তারা শহরগুলোতে আটকা পড়বে। যখন পাকসেনা ও তার দোসরেরা বঙ্গবন্ধুর ‘ভাতে মরা পানিতে মরা’র উপক্রম হবে তখনই নিচ্ছিহ্ন করা হবে পাকিস্তানিকে। এতে সমূলে ধ্বংস হবে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি থাকবে দীর্ঘমেয়াদী, তা চলতে পারে ৫/৭ বছরও। এসব কথা বলতে গিয়ে নেতারা বার বার সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণচিনের উদাহরণ দিতেন। বলতেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের কৌশলও। বারবার বলতেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আসলে জনযুদ্ধ। বিএলএফ সেই জনযুদ্ধকে সুসংগঠিত করতে চায়।

৪২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। অঞ্চল অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপ করা হয়। আমাদের গ্রুপ গড়ে ওঠে ১. আমি গ্রুপ লিডার, ২. আমজাদ হোসেন-সহকারি গ্রুপ লিডার (কালিয়াকৈর-মোহনপুর), ৩. এসএম হাসমত আলী (নলসন্দা-সলপ), ৪. এসএম আব্দুল মোত্তালেব (নলসন্দা-সলপ), ৫. শ্রী বৈদ্যনাথ দত্ত (নলসন্দা-সলপ), ৬. আব্দুস সাত্তার (তাড়াবাড়িয়া-সলপ), ৭. ফজলুল হক (চরনবীপুর- শাহজাদপুর), ৮. মোজাম্মেল হক, (রামকৃষ্ণপুর-উল্লাপাড়া), ৯. জয়নাল আবেদীন, (উল্লাপাড়া), ১০, সুরুতজ্জামাল, (রামকৃষ্ণপুর-উল্লাপাড়া), ১১. আয়নাল হক (কালিয়াকৈর-মোহনপুর) এবং ১২. নাসিমউদ্দিন (বড়জুমলা-উল্লাপাড়া)। আমাদের পাঠানো হয় পাঙ্গা ক্যাম্পে। এবার দেশে ফেরার পালা। ফুপাতো ভাই মতিউর বিএলএফ সদস্য হিসেবে পাবনা অঞ্চলের একটি গ্রুপভূক্ত হয়। ওকে বিদায় জানাতে গিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কারণ আমরা সিরাজগঞ্জের এ গ্রুপ বিএলএফে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছি মতিউরের সহযোগিতার কারণে। সে কারণে আমাদের সবার সাথে ওর এক ধরণের বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে। ওকে ছাড়তে গিয়ে সবাই কান্নাকাটি করতে থাকে। আর আমিতো ওর ভাই, আমার অবস্থা আরো খারাপ। তবুও এই যুদ্ধের প্রয়োজনে ওকে ছাড়তেই হয়। (ফুপাতো ভাই মতিউর পাবনা থেকে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে শেষ দিকে শাহজাদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পাবনার আতাইকুলায় আসার পর পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সেখানেই শহীদ হন মতিউর ও তার সহযোদ্ধারা।)

এবার আমাদের যাত্রা করার প্রস্তুতি। দুএক দিনের মধ্যেই আমাদের পাঠানো হবে বলে জানানো হয়, কিন্তু সে দুএক দিন আর শেষ হয় না। কেটে যায় প্রায় এক মাস। শোনা যায় যে, আমাদের যে রুটে পাঠানো হবে সে রুটে কোনও ঝামেলা হয়েছে। তারপরে আমাদের বাংলাদেশে ঢোকার রুট পরিবর্তন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় মাইনকারচর হয়ে বাংলাদেশের ঢোকার। আমরা ১২ জন প্রস্তুতি নিলাম। পরে জানা গেল, আমাদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠানো হবে বেশ কিছু বাড়তি অস্ত্র। নেতারা জানালেন, অস্ত্র নিয়ে যাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আমাদের শুধু অস্ত্রের সঙ্গে থাকতে হবে। তিন ট্রাকে বিপুল পরিমান অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো। সিরাজুল আলম খান আমার কাছে একটি পিস্তল দিয়ে সিরাজগঞ্জ ছাত্রলীগের নেতা আজিজুল হক বকুলকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বললেন। আমরা ১২ জন অস্ত্রের গাড়িতে উঠে চলে এলাম মাইনকারচর এলাকায়।

আমাদের আসার খবর আগেই দেওয়া হয়েছিল মাইনকারচর রৌমারীতে। শুধু তাই নয়, আমরা মাইনকারচর পৌঁছার আগেই পৌঁছে গেছেন বিএলএফের দুই নেতা সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক। সে অস্ত্র নামিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা রৌমারী থেকে মাইনকারচরে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে এই মূহুর্তে মোহনপুরের আব্দুল ওয়াহাবের নাম মনে আছে। আর মাইনকারচর থেকে সিরাজগঞ্জে অস্ত্র নিয়ে আসার জন্য উপস্থিত ছিলেন ইসহাক আলী আর আজিজুল হক বকুল। তারা আগেই নৌকা ঠিক করে রেখেছিলেন। সবাই মিলে সে অস্ত্র তোলা হলো দুটি নৌকায়। আর আমাদের জন্য অন্য একটি নৌকা দেওয়া হলো। পিস্তলটিও আমার কাছে থেকে চেয়ে নেন ইসহাক আলী আর আজিজুল হক বকুল। আমরাও উঠে পড়লাম নৌকায়। তখন বিএলএফ নেতা আব্দুল রাজ্জাক হাঁটু পানিতে নেমে আজলা ভরে পানি দিয়ে প্রতিটি নৌকার গলুই ধুঁয়ে দিলেন, যেভাবে মাঝিরা যাত্রা শুরুর আগে নৌকার গলুই ধুঁয়ে দিলেন, সবাইকে মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করে পাঠিয়ে দিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

আমাদের সিরাজগঞ্জ আসার রাস্তায় প্রধান বাঁধা বাহাদুরাবাদ ঘাট। সেখানে নিয়মিত পাকসেনার গানবোট টহল দেয়। তার ওপরে বাহাদুরাবাদ ঘাটে আসার আগ মূহুর্তে শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। এ সময় আমরা অন্য নৌকা দুটোকে হারিয়ে ফেলি। এর মধ্যেই পার হতে হয় ওই ঘাট। আমরা একটি চরে অপেক্ষা করি অন্য নৌকা দুটির জন্য। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর পাওয়া যায় অন্য নৌকা দুটো। এরপর আমরা চলে আসি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের তাড়াকান্দিতে চরে। সেখানে অস্ত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিরাজগঞ্জ বিএলএফের লিডার মোজাফ্ফর হোসেন মোজাম। তিনি অস্ত্র বুঝে নেন, আমাদের গ্রুপকে পাঠিয়ে দেন বেলকুচির দিকে। আমরা চলে আসি বেলকুচির রাজাপুর গ্রামে। ওই গ্রামের একটি বাড়ি হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে এসে জানার চেষ্টা করি এলাকার অবস্থা। তারপর চলে যাই নিজেদের সলপ এলাকায়। গ্রেনেড ছাড়া প্রায় সকল অস্ত্র লুকিয়ে ফেলি। আমাদের প্রধান কৌশল হয় বিএলএফ নির্দেশিত জনগণের আস্থা অর্জণ, সংগঠন গড়া আর পাকসেনা ও তার দোসরদের মনে ভীতির সৃষ্টি করা।

প্রথমেই এলাকায় তৎপর বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে তারা হলেন- খোরশেদ আলী অ্যাডভোকেট (পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক), কুয়াত-ইল ইসলাম (রাকসুর সাহিত্য সম্পাদক, এফএফ), মুকুল (শাহজাদপুর), আব্দুল হাই (উল্টাডাব), সোহরাব আলী (রায়দৌলতপুর), আনিসুর রহমান মামুন (রায়দৌলতপুর)সহ আরো অনেকের সঙ্গে। এই এলাকা বিএলএফের পক্ষে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ ছিল, কারণ এখানে কোনও বাহিনী গড়ে উঠতে পারেনি। আমরা সাধারণত নিজেদের নিরাপত্তা বজায় রেখে পাকসেনা ও রাজাকার ক্যাম্পের আশেপাশে গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং গোলাগুলি করতাম। এর মধ্যে উল্লাপাড়া, উল্লাপাড়া রেল স্টেশন, ঘাইটনা ব্রিজের আশপাশে গ্রেনেড বিস্ফোরণ গোলাগুলি অন্যতম। এ ছাড়াও বালসাবাড়ি সেতুতে কয়েকজন রাজাকার নিয়মিত পাহারা দিত। সেখানে আক্রমণ করে রাজাকারদের কাছে থেকে ৬টি রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়। এছাড়াও ২৬ নভেম্বর রাতে এলাকার বিভিন্ন গ্রুপ সমন্বিত ভাবে হামলা করে চৌহালী থানা হেডকোয়ার্টার মালিপাড়ায়। সেখানে পাকসেনা, চৌহালী থানা পুলিশ ও রাজাকারদের শক্ত ক্যাম্প ছিল, ছিল পাকা বাঙ্কারও। আমরা প্রধানত পাকসেনাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যেই এ আক্রমণ পরিচালনা করি। প্রায় ঘন্টা খানেক গোলাগুলি করে আমরা সরে আসি। পরের দিনই মালিপাড়া থেকে পাকসেনারা বিদায় নেয়। এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে সিরাজগঞ্জের থানা অঞ্চল মুক্ত হতে শুরু করে।

এ ঘটনায় স্বাধীনতা বিরোধীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমরা প্রায় প্রকাশ্যে চলে আসি। স্থানীয় রাজাকারেরা আমাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে অনেকেই। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও পালাতে শুরু করে। উত্তরবঙ্গ থেকে পাকসেনার গাড়ির বহর চলে যেতে থাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমাদের যুদ্ধাঞ্চলের কাছাকাছি বগুড়া-নগরবাড়ি সড়কই তাদের যাত্রাপথ। আমরা ছুটে যাই সেদিকে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে। যদিও সে চেষ্টা আসলে নিস্ফল চেষ্টা।

১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শহর থেকে পাকসেনারা উল্লাপাড়া হয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়, মুক্ত হয় মহুকুমা শহর। ১৩ ডিসেম্বর উল্লাপাড়া থানা ত্যাগ করে পাকসেনারা। আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি সলপ স্টেশনের পাশে সলপ হই স্কুলে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ আমাদের ক্যাম্প ঘেরাও করে তাদের দলভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানায়, আমরা তাতে অস্বীকৃতি জানাই। পরে পলাশডাঙ্গার পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা এসে তাদের সরিয়ে নিয়ে যায়। আরো পরে সিরাজগঞ্জ বিএলএফের গুরুত্বপূর্ণ নেতা রাকসুর জিএস আব্দুস সামাদ এসে আমাদের ক্যাম্পের কর্তৃত্ব নেন। এমনি সময় আমাদের কাছে খবর আসে যে, বিএলএফ নেতা শাজাহান সিরাজের কাছে থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন নির্দেশ পাই যে, বঙ্গবন্ধু দেশে না ফেরা পর্যন্ত বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করা থেকে বিরত থাকবে।

১৯৭২ সালের ৮ ও ১০ জানুয়ারি জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দিবসগুলি আমরা জনগণের সঙ্গে উৎসবের মতো করে পালন করি। এরপর অস্ত্র সমর্পণের পালা। ৩০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে বিএলএফের চার নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে আমাদের গ্রুপের সবাই অস্ত্র জমা দেই, শেষ হয় মুক্তিযোদ্ধা জীবন।

অনুলিখন : সাইফুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক, সমন্বয়ক- সিরাজগঞ্জ গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি

Advertisement
Share.

Leave A Reply